সাতসকালে হোক বা ভরসন্ধ্যায়
কবীর সুমনের লেখা ‘গানের ব্যারাম ও গলার ব্যায়াম’ (১৫-২) শীর্ষক রচনাটি সম্বন্ধে কিছু বলার আছে। সাতসকালে গলা সাধা নিয়ে বলতে গিয়ে সুমন জানিয়েছেন, ‘শুদ্ধ স্বরের সঙ্গে কোমলগুলিকে এবং তীব্র মধ্যমকেও সাধতে কোনও দিন কাউকে শুনেছি বলে মনে পড়ে না’। সবাই সাতটি শুদ্ধ স্বর নিয়েই সকাল থেকে ‘হাঁচোড়পাঁচোড়’ করে চলেছেন। প্রথমত, এটি কবীর সুমনের একান্ত নিজের অভিজ্ঞতা। সেই সূত্রে তাঁর আক্ষেপ, ‘কোমল-তীব্র পাঁচটিকে বাদ দিয়ে কেবল সাতটি স্বর নিয়ে’ গলা সাধা অর্থহীন।
হারমোনিয়ামে আমরা যে কোনও সপ্তকে (যদিও পশ্চিমে অক্টেভ) শুদ্ধ কোমল ও তীব্র মিলিয়ে বারোটি স্বর পাই। কিন্তু সবিনয় জানাই, ভারতীয় রাগসংগীতে সাতটি শুদ্ধ স্বরের মধ্যেই বিকৃত পাঁচটি স্বর নিহিত আছে। আসলে ভারতীয় রাগসংগীত হল সম্পূর্ণ ভাবে শ্রুতিনির্ভর। সেই জন্য ‘সা’ কে ষড়জ বলা হয়েছে। অর্থাত্ সা থেকে রে গা মা পা ধা নি এই বাকি ছ’টি স্বর উত্পন্ন হচ্ছে। এবং প্রত্যেকটি শুদ্ধ স্বরের শ্রুতির মধ্যে ঢুুকে থাকছে বিকৃত অর্থাত্ কোমল ও তীব্র স্বর। সেই মতো সা থেকে নি পর্যন্ত মোট বাইশটি শ্রুতি পরিমাপ করা হয়েছে। শ্রুতিনির্ভর ভারতীয় রাগবিদ্যায় তাই কোমল আশাবরীর কোমল ধৈবত ও পূর্বীর কোমল ধৈবত সম্পূর্ণ আলাদা। এবং এখানেই ভারতীয় রাগসংগীতের বিশেষত্ব।
সপ্তদশ শতকে ‘রাগবিবোধ’-এ সোমনাথ বলেছেন, সুষুম্না নাড়ির ওপরের দিকে ইড়া ও পিঙ্গলা নামের দুটি নাড়ি আছে এবং এর সামান্য নীচে আছে ছেদযুক্ত বাইশটি নাড়ি। এখানেই ২২টি শ্রুতির অবস্থান। তাবন্তঃ শ্রুতিসংজ্ঞাঃ স্যুর্নাদাঃ পরপরোচ্চোচ্চা। আচার্য সোমনাথের মতে, উক্ত নাড়িগুলি থেকেই নাদ, বিকৃত, ও শুদ্ধ স্বরগুলির উত্পত্তি— স্বরস্থিতর্বিশুদ্ধানাং বিক্রতানাশ্চ নিণর্র্য়ঃ। ত্রয়োদশ শতকে শার্ঙ্গদেবের ‘সংগীতরত্নাকর’-এও একই কথা বলা হয়েছে। পণ্ডিত অহোবল ‘সংগীত পারিজাত’-এ বলেছেন যে, সাপের সঙ্গে কুণ্ডলীর যেটুকু তফাত, স্বর ও শ্রুতির পার্থক্য ততটুকুই।
তাই পূর্বাচার্যদের মত অনুসরণে বলা যায় যে, শুদ্ধ স্বরগুলি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং তানপুরায় সেগুলিকে লাগানোর ক্ষমতা অর্জন করাটা সবচেয়ে জরুরি। তা সেটি সাতসকালেই হোক বা ভরসন্ধ্যায়। এই জন্য কবীর সুমনের শোনা ‘বেশির ভাগ ‘পালটা’ই শুদ্ধ স্বর দিয়ে তৈরি’। শুদ্ধস্বরযুক্ত পালটা নির্ভুল ভাবে গাইতে পারলে বিকৃত স্বরগুলি চেনা বা আয়ত্তে আনা সহজ হয়। শিক্ষার শুরুতেই সাধারণ মানের শিক্ষার্থী সা এবং কোমল রেখাবের দূরত্ব মাপতে গেলে সান্ধ্যভাষার মতো সান্ধ্য-স্বর অবস্থার মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাবেন। তাই শুদ্ধস্বরযুক্ত পালটায় গলা ও মাথা তৈরি হলে বিকৃত স্বরযুক্ত ঠাটে পালটাগুলি অভ্যাস করলে সমস্যার সহজ সমাধান আপনিই হয়ে যাবে। তখন মিঞা মল্হারের শুদ্ধ নি ও কোমল নি নিয়ে যত খুশি হাঁচোড়পাঁচোড় করা যাবে। অর্থাত্ গলার ব্যায়ামের সঙ্গে সঙ্গেই মাথার ব্যায়ামটাও হয়ে যাবে।
এই হল গলার ব্যায়াম, কণ্ঠচর্চার কিছু পরীক্ষিত উপায়। যে প্রক্রিয়া অবলম্বন না-করলে গায়ক গায়িকা তৈরি হবেন না।
রচনার শেষাংশে সুমন লিখেছেন, ‘আপশোসের কথা হল, সংগীতচিন্তায় ভারতের ঐতিহ্য হাজার চারেক বছরের পুরনো হলেও, উপমহাদেশে রাগসংগীত, পল্লিসংগীত ও আধুনিক সংগীত এত বিচিত্র ও উঁচু মানের হলেও, গানের গলা তৈরি এবং গানের গলা দীর্ঘ কাল রক্ষা করার কোনও সর্বজনগ্রাহ্য ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি আমরা তৈরি করতে পারিনি।’
গানের গলা তৈরির সর্বজনগ্রাহ্য ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি নিয়ে খুব সংক্ষেপে যেটুকু বলা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করছি। সুমন নিজেও রাগসংগীত-সহ বাজারচলতি গান গাইতে গেলেও পালটা শেখার কথা লিখেছেন। তাঁর ভাষায় ‘গলার ব্যায়াম’।
দ্বিতীয় কথা হল, তৈরি গলাকে দীর্ঘ কাল রাখার জন্য সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, যে সব শিল্পী জরা বা বার্ধক্যজনিত পঙ্গুত্বকে জয় করতে পেরেছেন, তাঁরাই গলার আওয়াজ এবং গায়কি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। গলাকে দীর্ঘ কাল ধরে রাখার জন্য জীবনচর্যা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্যদের পদ্ধতি দিয়ে তো জিনিয়াসদের মাপা হয় না। আবার সংগীত-কাব্য-কলা-বিজ্ঞান সবই তো বেঁচে থাকে জিনিয়াসদের মধ্যেই। সুমন নিজেই বলেছেন, ‘আশ্চর্য, কারও কারও গলায় তার (স্বরের খেলা, সুরের কারুকাজ) কিছু কিছু বিনা তালিমে বিনা কণ্ঠচর্চাতেও এসে পড়ে। যেমন ছোট ছোট তান। সবার গলায় কিন্তু আসে না।’ এই জন্যই দীর্ঘ তালিম ও নিত্য রেওয়াজের পরেও কলাকার বা শিল্পী হওয়ার জন্য তৃতীয় কোনও কিছুর দরকার। আর তাই সুমনের সুরে বলতে হয়, আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান বা আমির খানের শিষ্য-শিষ্যাদের সবাই তাঁদের মতো হন না।
অপিচ, আমাদের দেশে রাগসংগীত রক্ষার জন্য, গায়কি ধরে রাখার জন্য গুরু-শিষ্য পরম্পরা তো আছেই। সেই সূত্রেই তো আমরা হরিদাস স্বামী, নায়ক গোপাল, তানসেনের ধ্রুপদ— সদারঙ্গ-অদারঙ্গ-মনরঙ্গ প্রমুখের খেয়াল পাচ্ছি। আবার সরস্বতী বাই রানে-র গলা আচমকা শুনলে মনে হবে আবদুল করিম খান শুনছি। গলার আওয়াজের ওপরও দাঁড়িয়ে আছে ঘরানা পরম্পরা। যেমনটি আছে যন্ত্রসংগীতে বাজ বা বাদনপদ্ধতি।
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। পশ্চিম অরবিন্দনগর, বাঁকুড়া
আজ হঠাত্
কবীর সুমন নজরুল মঞ্চে সঙ্গীত মেলার উদ্বোধনী আসরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, “এই পুরস্কারটি শুধু কবীর সুমনই পাচ্ছে না, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নাকতলা শাখায় আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটিও পুরস্কার পাচ্ছে। টাকাটা আমার দরকার।” (‘কোথাও যাওয়ার নেই...’, ১৪-২)। ২০০৯ সালে সাংসদ হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই তাঁর কাজ ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা ও তৃণমূল কংগ্রেসের মুণ্ডপাত করা। অম্বিকেশ, শিলাদিত্য, কামদুনি থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি অভিযান নিয়েও সরকার বিরোধী গান বেঁধে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বিদ্ধ করেছেন, আজ হঠাত্...?
রতন চক্রবর্তী। উত্তর হাবড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা