ঘাতক। নাথুরাম গডসে (১৯ মে, ১৯১০ -- ১৫ নভেম্বর, ১৯৪৯)
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী নামক ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিসম্পন্ন নেতার জাতীয় রাজনীতিতে উল্কাসম উত্থান ঘটা ইস্তক লালকৃষ্ণ আডবাণীকে যতই আগমার্কা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী নেতার মতো দেখাক, তাঁর ইতিহাসটি ভুলে না যাওয়াই বিচক্ষণের কাজ হবে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অত্যুত্সাহে তিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদকে ফের জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের হাতুড়িটা তাঁর হাতেই ছিল। এহেন আডবাণীও কিন্তু নাথুরাম গডসেকে জনসমক্ষে আপন করে নিতে সাহস করেননি। বলেছিলেন, গাঁধীর দিকে বন্দুক তাক করার ঢের আগেই গডসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। অতএব, গাঁধীহত্যার দায়টি গডসের নিজস্ব, সংঘের নয়। তাঁর এই কৈফিয়ত অবশ্য ধোপে টেকেনি। নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে প্রকাশ্যেই তুলোধোনা করেছিলেন আডবাণীকে। তবে একা আডবাণী নন, গডসেকে নিয়ে এমন অস্বস্তিতে ভুগেছে গোটা দলই। অন্তত, কিছু দিন আগে পর্যন্ত। এবং, এই অস্বস্তিটি তাত্পর্যপূর্ণ।
আডবাণীর প্রধানমন্ত্রিত্বের খোয়াবকে সবরমতীর জলে চিরতরে বিসর্জন দিয়ে দিল্লির তখ্ত দখল করার পর বছর ঘুরতে পারেনি, তার আগেই মোদীর ভারতে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা উত্তরপ্রদেশের সীতাপুরে গডসের মন্দির তৈরির দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিয়েছে। ৩০ জানুয়ারি ভিত প্রতিষ্ঠা হবে মন্দিরের। সাতষট্টি বছর আগে যে দিন গাঁধীর বুকে বুলেট গেঁথে দিয়েছিলেন নাথুরাম। অর্থাত্, নাথুরাম শুধু উপাস্য নন, শুধু সংঘের হিন্দুত্ববাদের মুখ বলেই উপাস্য নন, তিনি গাঁধী নামক বিরুদ্ধ শক্তির বিনাশক হিসেবে উপাস্য। দিনটিকে সাধে শৌর্য দিবস বলে ঘোষণা করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি?
আডবাণীর দ্বিধাবিজড়িত অস্বীকার আর নরেন্দ্র মোদীর জমানায় মন্দির স্থাপন করে গডসের উপাসনার বন্দোবস্ত, দুটো আসলে দুই আলাদা ভারতের কথা। আডবাণী যে ভারতে হিন্দুত্ববাদী খণ্ড জাতীয়তার বেসাতি করতেন, সেটা ছিল জওহরলাল নেহরুর ভারত। যেখানে মনে যা-ই থাক, রাজনীতির মূলধারায় প্রকাশ্যে সম্মান করতেই হত ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চরিত্রটিকে। সেই ভারতে গাঁধীই ছিলেন জাতির প্রতীক, আর গডসে তাঁর ঘৃণ্য খুনি। শুধু গাঁধীর বুকে তো পিস্তল দাগেননি গডসে, গুলি চালিয়েছিলেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উদ্দেশে। সেই মারাত্মক হিংস্রতাকে জনসমক্ষে স্বীকৃতি দেওয়ার উপায় বা সাহস, কোনওটাই ছিল না এমনকী আডবাণীরও। তাঁর ভারতে সংসদে বীর সাভারকরের ছবি টাঙানো নিয়ে বিতর্ক হত। দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক সাভারকর, বহু সাক্ষ্যে গাঁধীহত্যার নেপথ্য কারিগর হলেও তাঁর হাতে পিস্তল ওঠেনি। তবু, আডবাণীর ভারতে প্রশ্ন উঠেছিল— যে সংসদে গাঁধীর ছবি থাকে, সেখানে কী ভাবে ঠাঁই হতে পারে সাভারকরের?
নরেন্দ্র মোদী অন্য ভারতে সিংহাসন পেতেছেন। নেহরুর ভারতের মৃত্যুপরোয়ানায় সই করেই তাঁর শাসনকালের সূচনা। গুজরাত-গণহত্যার রক্তের দাগ তাঁর হাতে আছে কি নেই, সে বিচার না করেই এই ভারত তাঁকে বরণ করে নিতে পারে গণতন্ত্রের শীর্ষাসনে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির মূল স্রোতে হিন্দুত্ববাদকে ঠাঁই করে দেওয়ার লড়াই আর তাঁর নয়। সে লড়াই জেতা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর, সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদকেই ভারতীয় জাতীয়তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধ লড়বেন তিনি, তাঁরা। গডসের মন্দির তারই এক ধাপ। আরও অনেক পথ চলা বাকি আছে অবশ্য।
গডসে উপাস্য, কারণ গাঁধীর রাজনীতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর সহনশীল রাস্তায় হাঁটেননি তিনি। হত্যামামলার বিচারের সময় তাঁর বয়ান প্রমাণ করেছিল, তিনি অন্ধ হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী ছিলেন না। বরং, তাঁর রাজনীতি, তাঁর মতো করেই, যুক্তিতে শানিত ছিল। হিন্দুত্ববাদের যুক্তি, মুসলমান-বিদ্বেষের যুক্তি, কিন্তু যুক্তি তো। গাঁধীর সামনে সেই যুক্তি সাজাননি তিনি, কোনও গণতান্ত্রিক তর্কের পথে হাঁটেননি। বরং, গুলি চালিয়েছিলেন। নেহরুর ভারতে এমন অসহনশীলতা রাজনৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, বরং সংঘ পরিবার চিরকালই নেহরুর বিশালত্বের সামনে খানিক হীনম্মন্যতায় ভুগত। অতএব, আডবাণীদের গুরুজি গোলওয়ালকরও তাঁর গাঁধী-বিদ্বেষ রেখেঢেকেই প্রকাশ করেছেন। সেই আগলটি এত দিনে ভেঙেছে। এই নরেন্দ্র মোদীর জমানায় যাঁরা ‘রামজাদে’ নন, তাঁদের পরিচয়টি ছন্দ মিলিয়ে দিব্য বলে দেওয়া যায়। হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাকে মেনে না নিতে পারলে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া যায়। ঘোষণা করা যায়, ভারতে শুধু হিন্দুদেরই অধিকার। আর কোনও তর্কের প্রয়োজন নেই, দরকার নেই কোনও এনগেজমেন্টের। উগ্র অসহিষ্ণুতা শাসকের সম্মতি পেয়েছে এত দিনে। এই ভারতে নাথুরাম গডসে, তাঁর সমস্ত অসহিষ্ণুতা সমেত, উপাস্য হবেন, তাতে আশ্চর্য কী?
এক হিসেবে সেই মন্দির এক ব্যক্তির। অন্য দিক থেকে দেখলে, ব্যক্তি গৌণ— এই মন্দির আসলে প্রতীকী। উগ্রতার প্রতীক তো বটেই। কিন্তু উগ্রতা পন্থামাত্র। যে আদর্শটি প্রতিষ্ঠার জন্য এই উগ্রপন্থাই এখন শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হচ্ছে, মূল তাত্পর্য তার। গডসের মন্দির আসলে ভারতের জাতীয় রাজনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার, সহনশীলতার শেষ আব্রুটিও খসে যাওয়ার প্রতীক। নেহরু-যুগের আদর্শের সমাধিসৌধ। মন্দিরটি নিতান্তই মোদী-পর্বের। আডবাণীকেও রাম-জন্মভূমির কল্প-ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হয়েছিল, হিন্দুত্ববাদের যৌক্তিকতা সন্ধান করতে হয়েছিল ‘ইতিহাসের ভুল’ সংশোধনের মোড়কে। মোদী পর্বের রাজনীতিতে আর সেই বালাইও রইল না। অতঃপর, হিন্দুত্ববাদই যথেষ্ট যুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে থেকে তার জন্য আর যুক্তি সন্ধান করতে হবে না। ভারত থেকে নেহরু যুগকে মুছে ফেলার যে প্রকল্পটি সংঘ পরিবারের মনের মণিকোঠায় সযত্নে রক্ষিত ছিল দীর্ঘ কাল, নরেন্দ্র মোদী বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তার বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন। আরও হাঁটবেন, অনুমান করা চলে।
অযোধ্যা যে নেহাতই ঝাঁকিদর্শন ছিল, কাশী-মথুরা ও আরও অনেক কিছু যে এখনও বাকি, সে বিষয়ে এখনও যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে, ৩০ তারিখে গডসে মন্দিরের শিলান্যাসের পর সেটুকু মুছে ফেলা যাবে বলেই আশা।