সে একটা সময় ছিল! ক্লাস নাইন। শরীর-মনে মারাত্মক ‘মেটামরফোসিস’ হচ্ছে তখন। তারই মধ্যে স্কুলে সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব। আশির-নব্বইয়ের দশকে অনেক বাংলা মাধ্যম স্কুলেই এটা চল ছিল। ক্লাস নাইন পুজো করবে। দিদিমণি-মাস্টারমশাইরা আড়াল থেকে নজরদারি রাখতেন নিশ্চয়ই, সরাসরি মাথা গলাতেন না।
চোদ্দো-পনেরোর ফুটন্ত হৃত্পিন্ডে বড় হওয়ার তীব্র ইচ্ছে তখন বুড়বুড়ি কাটছে, কিন্তু সাবালকত্ব প্রমাণের পথ পাচ্ছে না। সেই মোক্ষম মুহূর্তে হাতে এসে পড়ত সরস্বতী পুজো। ওই বয়সে এর থেকে বড় গুরুদায়িত্ব কে ভরসা করে দেবে? বড়ত্বে উত্তরণের আত্মবিশ্বাস লুটেপুটে নেওয়ার সেটাই ছিল ট্রাম্প কার্ড।
পুজোর আয়োজনের মধ্যেই অজান্তে অস্তিত্বের ভিতর শিকড় ছড়াত সাংগঠনিক ক্ষমতা। হাতেকলমে প্রথম প্রয়োগ করা যেত সৃষ্টিশীলতা। একশো শতাংশ ‘পারফেক্ট’ হত না সব কিছু, কিন্তু সেই না-পারা থেকে অনেক কিছু শেখা হয়ে যেত। বিশ্বাস করুন, দিদিমণিরা হাতে ধরে পুজোর ভার দেওয়ামাত্র ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু, নিয়মভাঙা মেয়েটিও কোন ম্যাজিকে শৃঙ্খলাপরায়ণ, দায়িত্ববতী হয়ে যেত। বড় হওয়ার চৌকাঠে সেটাই ছিল সত্যিকারের পা রাখা।
প্রাপ্তবয়স্ক অনুভবের এক অনাঘ্রাত জগতের সঙ্গে গোপনে আলাপ করিয়ে দিত এই সরস্বতী পুজোই। অনভ্যস্ত শাড়ি বা ধুতি আর চোরা চাহনিতে রাতারাতি কৈশোর টপকে ছুঁয়ে যাওয়া যেত যৌবন। ছেলেদের স্কুলে মেয়েদের আর মেয়েদের স্কুলে ছেলেদের গটগট করে ঢুকে নেমন্তন্নের চিঠি দেওয়ার বৈধ ছাড়পত্র মিলত শুধু এই সময়টায়। মোবাইল, ফেসবুক, চ্যাট ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণাহীন আমাদের সেই বয়ঃসন্ধিতে এইটুকু পাওয়াতেই মনের চিরহরিত প্রান্তর শিহরিত হত।
আশির দশকের শেষে উত্তর কলকাতার বাগবাজার এলাকার এক নামী বাংলা মাধ্যম গার্লস স্কুলে পৌঁছলাম ক্লাস নাইনে। জানুয়ারির শুরুতে এক দিন দিদিমণিরা ক্লাসে মিটিং করলেন। সরস্বতী পুজোর কাজ ভাগ করে দেওয়া হল মেয়েদের মধ্যে। ঠাকুর পছন্দ করা আর বাজার করার একটা দল, ঠাকুর নিয়ে আসা আর বিসর্জনের দল, ইস্কুলবাড়ি সাজানো আর আলপনা দেওয়ার দল, ঠাকুরমশাইকে হাতে হাতে সাহায্য করা আর ফল কাটার দল, ভোগ পরিবেশনের জন্য এক দল আর কার্ড পছন্দ করে স্কুলে স্কুলে নেমন্তন্ন করার দল। উফফফ! তানিয়া-মোনালিসা-সঙ্গীতাদের কী ভাগ্য, কী ভাগ্য! ঠিইক নেমন্তন্ন করার দলে নাম উঠেছে। তার মানে হিন্দু, হেয়ার, স্কটিশ, এভি, সংস্কৃত কলেজিয়েট— সঅব ছেলেদের স্কুলে যাবে! বাকি দলের সদস্যরা আফশোসে কালি-কালি!
কিন্তু হতাশা-টতাশা নিয়ে বিলাপ করে সময় নষ্ট করা যাবে না। হাতে মেরেকেটে দিন কুড়ি। এ হল সম্মানের যুদ্ধ। একটু ত্রুটি হলেই সবাই বলবে, ‘এ বারের ক্লাস নাইনটা যাচ্ছেতাই। স্কুলের নাম ডোবাল।’ অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা ঠাকুর দেখতে এসে সব কিছু খুঁটিয়ে পরখ করবে। পুজো খারাপ হলে আলগা ছুঁড়ে দেওয়া টিটকিরি-ব্যঙ্গ অবধারিত। এ হতে পারে না। মাথা নিচু করা যাবে না। হেঁইসা মারো।
পরের কুড়িটা দিন সরস্বতীর আরাধনার আয়োজনে পড়াশোনা লাটে। সকাল থেকে সন্ধ্যা দৌড়-দৌড় আর মাথা খুঁচিয়ে যুদ্ধকালীন পরিকল্পনা। চারটের সময় ছুটির পরেও ক্লাস নাইন বাড়ি যাচ্ছে না। সন্ধে পর্যন্ত স্কুলে। কর্মযজ্ঞের মধ্যে হঠাত্ মন উচাটন! স্কুলে বিদ্যুত্বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ছে স্কটিশের ছেলেরা এসে গিয়েছে কার্ড নিয়ে, এই শৈলেন্দ্র সরকারের ছেলেরা ঢুকল। পড়িমরি করে মেয়েরা সিঁড়ির নির্দিষ্ট কোণে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
পুজোর আগের সন্ধে। পদে-পদে বিচিত্র সমস্যা। পেপার কাটিং করে নানা রকম নকশা ফাটাফাটি বানাতে পারে শান্তা। ওকে সাহায্য করার কথা ছিল ত্রিপর্ণার। কিন্তু এমন জ্বরে পড়ল যে, ফিনিশিং টাচে আসতেই পারল না। দিব্যি সুন্দর আলপনা দিয়েছিল সারদা আর রণা। বেখেয়ালে ক্লাস ফাইভের দু’টো মেয়ে এক্কেবারে মাঝখানে পা দিয়ে দিল সব ধেবড়ে। ঠাকুর আনতে গিয়ে নন্দিনীদের চোখ কপালে। মুখটা যেমন করতে বলা হয়েছিল মোটেই সে রকম হয়নি, কেমন যেন কাঠ-কাঠ। চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম। কাল যে হালকা কমলা রঙের শাড়িটা পরব বলে বেছে রেখেছি তার ম্যাচিং ব্লাউজটা হঠাত্ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই রকম নানা উত্তেজনায়, উন্মাদনায় কখন যেন রাত কেটে গেল। পর দিন সক্কালবেলা ওঠা। শ্যাম্পু করা, কপালে মেরুন টিপ, মাকে দিয়ে কুঁচি ধরিয়ে চারটে সেফটিপিন লাগিয়ে শাড়ি পরা। মুগ্ধ চোখে নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে সোজা স্কুলে। সকালের পুষ্পাঞ্জলি থেকে রাতের বিচিত্রানুষ্ঠান পর্যন্ত স্বপ্নের মতো কেটে যাওয়া একটা দিন।
মনের দেরাজে ন্যাপথলিনের সুগন্ধ মেখে সযত্নে রয়ে গিয়েছে স্মৃতিগুলো। অনভ্যস্ত অনভিজ্ঞ হাতে বঁটি ধরে আপ্রাণ শাঁকালু কাটার চেষ্টা হোক কিম্বা গলদঘর্ম হয়ে স্কুলের ঘরে সার-সার কলাপাতায় লুচি-তরকারি-বোঁদে পরিবেশন করতে গিয়ে মাটির ভাঁড়ের জল উল্টে ফেলা, ফুলকপির তরকারি কম পড়ায় পড়িমড়ি বাজারে দৌড়নো, পুজোর ঘরে ঝকঝকে চোখের ছেলেটাকে এক ঝলক দেখে দু’রাত ঘুমোতে না পারা— সব কিছু। দুপুর গড়িয়ে নেমে পড়া হত রাস্তায়, দল বেঁধে। মাঘের নরম রোদ্দুরে বাগবাজার স্ট্রিট, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, হাতিবাগান, আহিরিটোলার রাস্তায় উজ্জ্বল মুখের ঢল। এক স্কুল থেকে অন্য স্কুল বা কলেজ।
এখন লটকে লট ইংলিশ মিডিয়াম। তার বেশির ভাগেই সরস্বতী পুজো হয় না। স্কুল সে দিন ছুটি থাকে। হাতে গোলাপি, নীল চাঁদার বই নিয়ে হইহই করে ছোটদের যে দলগুলো চাঁদা চাইতে বেরিয়ে পড়ত তাদেরও আজকাল দেখতে পাই না। রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো ছোট্ট মণ্ডপ, আনাড়ি হাতে লাগানো কাগজের শিকল। সামনে কলা, কমলালেবু, নাড়ু, কুলের প্রসাদ সাজিয়ে পুরোহিতমশাইয়ের জন্য অপেক্ষা, সে সব নেই। এখন বেশির ভাগ খুদে-র সরস্বতী পুজো করার সময় বা আগ্রহ নেই। অভিভাবকেরাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে এনার্জি নষ্ট করে লাভ নেই। বরং সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা। সরস্বতী পুজোর আয়োজনের বদলে পড়া রিভিশনে মন দাও। ভবিষ্যত্ সুরক্ষিত হবে।
অতএব, কোচিং সেন্টারে বা আঁকার স্কুলে চাঁদা দিয়ে দায়িত্ব খতম। সেজেগুজে অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ নিয়ে এসো। বিকেলে শপিং মল, কফি শপ, মাল্টিপ্লেক্স। সরস্বতী পুজো এনজয় করা হল। পরের দিন থেকে আবার কেরিয়ারে মন দাও। হয়তো যুগধর্ম, তবু আশির দশকে বাংলা মাধ্যমে পড়া মনটা মুচড়ে ওঠে। নিজেদের হাতে কোনও জিনিস সংগঠিত করার ভিতটাই তৈরি হল না তো। দায়িত্ব নেওয়া, দায়বদ্ধ থাকা, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা, পরিস্থিতির মোকাবিলা করা শেখা হল না বয়ঃসন্ধিতে। উত্সব উদ্যাপন মানে তারা জানল মোবাইল টেক্সট আর ই-কার্ড পাঠানো। ভয় হয়, বিশ-পঁচিশ বছর পরে মনের পাতা উল্টে রোমন্থন করার মতো সরস্বতী পুজোর কোনও স্মৃতি থাকবে না এদের।