প্রশাসনে স্বচ্ছতা বলিতে কী বুঝায়? খোলামেলা ভাবে শাসনপ্রণালী সঞ্চালিত করা, যাহাতে শাসিতদের মনে এই সংশয় না জাগে যে, সরকারের লুকাইবার কিছু আছে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতে শাসকের পরিবর্তন হইলেও শাসনপ্রণালীর ব্যাধিগুলি সহসা ঘুচিতে চায় না, যদিও তাহা ঘুচাইবার প্রতিশ্রুতি দিয়াই রাজনৈতিক দলগুলি জনাদেশ যাচ্ঞা করিয়া থাকে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ‘গ্রিনপিস’-এর সদস্য প্রিয়া পিল্লাইকে লন্ডনে একটি আলোচনাচক্রে যোগ দিবার জন্য ভারত ছাড়ার পূর্বাহ্ণে, একেবারে শেষ মুহূর্তে বিমানবন্দরে আটকাইয়া দেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার সংশয় জাগ্রত হওয়া অস্বাভাবিক নহে। শ্রীমতী পিল্লাই দেশের কোনও আইন ভঙ্গ করেন নাই। অন্তত তেমন কোনও অভিযোগ তাঁহার বিরুদ্ধে সরকার করে নাই। প্রয়োজনীয় বৈধ ভিসাও তাঁহার ছিল। তথাপি তাঁহাকে সরকারি নির্দেশে বিমানবন্দরে আটকাইয়া দেওয়া হইল এবং তিনি তাহার কারণ জানিতে চাহিলেও তাঁহাকে সেই মর্মে কিছুই জানানো হইল না। শোনা গেল, লুকআউট তালিকায় নাকি তাঁহার নাম আছে। স্বদেশ মন্ত্রকের নিকট আবার সেই খবর নাই। মগের মুলুকে এই ধরনের স্বেচ্ছাচার চলিতে পারে, গণতন্ত্রে নয়।
ইহা ব্যক্তি-স্বাধীনতা, গতিবিধির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তাঁহাকে লন্ডনে যাইতে না দিবার কারণটি খোলসা না করিলেও আভাস মিলিতেছে, প্রিয়া পিল্লাই ব্রিটিশ সাংসদদের কাছে এমন একটি বিষয়ে রিপোর্ট দিতে যাইতেছিলেন, যাহাকে ভারতীয় শাসকরা অস্বস্তিকর মনে করেন। তিনি খনি নির্মাণের সরকারি নীতির ফলে বনাঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতিদের অধিকার খর্ব হওয়ার বিষয়ে রিপোর্ট দিতেন। ইহাই তাঁহার কাজের বিষয়। তথাকথিত সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়ণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হইতে পারে, এই আশঙ্কা অহেতুক নহে। এই প্রেক্ষিতেই সংশয় হইতে পারে যে, পরিবেশগত ভারসাম্য বিনাশের লুকাইয়া রাখার বাস্তবতাটি ফাঁস হওয়ার শঙ্কা হইতেই গ্রিনপিস ও অনুরূপ এনজিওগুলির প্রতি বর্তমান সরকার বিরূপ। শ্রীমতী পিল্লাই মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের উপর যে-কয়লাখনি খননের ধ্বংসাত্মক পরিণাম নথিভুক্ত করিতেছিলেন, সেখানেও উন্নয়নের কাজে বাধাদানের অজুহাতে এনজিওর কাজকর্মে রকমারি বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ উঠিয়াছে এবং স্থানীয় জনজাতিদের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া নূতন খননের নির্দেশ গিয়াছে। গত বছর গ্রিনপিসের এক ব্রিটিশ সদস্যকে বৈধ ভিসা সত্ত্বেও এ দেশে কাজ করিতে দেওয়া হয় নাই, ফিরতি বিমানেই তুলিয়া দেওয়া হয়। এই সবই ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করার নজির।
পরিবেশের প্রশ্নে অস্বচ্ছতা ভারতীয় রাজনীতির অভিজ্ঞান। নরেন্দ্র মোদীর সরকারও আপাতদৃষ্টিতে সেই ধারার স্বেচ্ছা-বাহক। পরিবেশের সহিত আর্থিক বৃদ্ধির উচ্চ হারের বিরোধ থাকিতেই পারে। সরকার সেই বিরোধে কোন অবস্থান লইবে, তাহা সরকারকেই স্থির করিতে হইবে। যদি স্থির হয় যে আর্থিক বৃদ্ধির সম্ভাবনা খর্ব করিয়া পরিবেশ রক্ষার কাজ চলিবে না, এবং সেই সিদ্ধান্তটি যদি আন্তর্জাতিক নীতির সহিত সঙ্গতি বজায় রাখিতে পারে, তবে সরকার সেই কথাটিই জানাইয়া দিক। তর্ক হউক, কিন্তু সরকারের অবস্থানটি স্বচ্ছ থাকুক। তাহা না করিয়া যদি বিভিন্ন চোরাপথে পরিবেশের প্রশ্নটি ঠেকাইবার চেষ্টা হয়, তবে তাহা একান্তই অগ্রহণযোগ্য। প্রিয়া পিল্লাইয়ের ঘটনাটি সেই গোত্রের।