আবেগ সতত যুক্তিহীন? যাদবপুরে ছাত্রনিগ্রহের প্রতিবাদে মিছিল, ২১ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই
একঘেয়ে, বিবর্ণ ও বিরস দিনের মধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর অজস্র শব্দ মিছিল করে ঘরে ঢুকে পড়েছিল, কলরবে, আন্দোলনের অবয়বে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘেরাটোপ থেকে মহানগরের নানা জনপরিসরে। আন্দোলন ও কলরব তো তা-ই, পরিসর অতিক্রম করাই তো দুইয়ের ধর্ম, তাই কত কাল আগে শঙ্কিত ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘মনে এই আন্দোল কন্দল হয় পাছে।’ নিজস্ব দোলনে ও কম্পনে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়াটা আন্দোলন, সে ভাবে গানে একদিন শব্দটি ধ্বনিত হয়েছিল, ‘মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে, ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে।’
স্বাভাবিক অনুষঙ্গেই ২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর-এর নন্দীগ্রামে গুলিচালনার বিরোধী মহামিছিলের তুলনা আলোচনায় এসেছে, কারও কারও চকিতে কামদুনির নারীধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে নাগরিক মিছিলের কথা মনে পড়েছে, ঘর সেদিনও বাইরের পরিসরকে ব্যাপ্ত করেছিল। সেই মিছিলগুলি শব্দে সরব হয়ে ওঠেনি। নৈঃশব্দ্যের অভিঘাত অবশ্যই উপেক্ষণীয় নয়, ঘৃণা, ক্রোধ ও লজ্জার জমাট বাঁধা সংহত রূপের প্রকাশ। অন্য পক্ষে, কলরবের নানা শব্দ নানা ভাবে ছড়ায় পরিসরের কোনও আগমার্কা প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তে, সংহতির কোনও লৌহকঠিন কাঠামোয় তাদের আটকে রাখা অসম্ভব। শব্দ খেয়ালি, স্লোগান পাখা মেলে। কাজে কর্মে, মননে চিন্তনে স্বভাবগুণেই শব্দগুলি অভিধা ছাড়িয়ে প্রসারিত হয় লক্ষণায়, লক্ষণার পরিসরকে অতিক্রম করে অনুরণিত হয় ব্যঞ্জনায়। ২০ সেপ্টেম্বর তিলোত্তমা কলকাতার কল্লোলে শব্দ-শক্তির তাৎপর্যই মনেপ্রাণে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম, জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছিল।
কর্মজীবনে ‘একনাগাড়ে’ পনেরো বছরের অনেক বেশি সময়ই লাইব্রেরি ও আর্কাইভসের আনাচ-কানাচে আরামে হাবিজাবি খোঁজার আনন্দে সময় কাটিয়েছি, খালি মাঝে মাঝে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নগণ্য কর্মী হিসেবে শব্দে শব্দ মিলিয়েছি। সেই স্মৃতির চালচিত্র গড়ে উঠেছে দু’টি সুতলির আদত বোনায়, মাঝে অন্য নকশারও কারুকাজ আছে। এক পক্ষে প্রশাসনিকতার দণ্ড, তার সঙ্গে সঙ্গে পরিসরকে, ছাত্রধর্ম তথা প্রজাধর্মকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ম্যানেজমেন্টের কৃৎকৌশল, ভাষার ফেরফার। অন্য পক্ষে, নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণকে বাতিল করার জন্য কিছু বেআদব নাগরিকের উদ্যোগে জমায়েত ও সমাবেশের ক্ষেত্রকে যত্রতত্র প্রসারিত করার চেষ্টা, জিগির তুলে, ১৪৪ ধারা ভেঙে, লক-আপে গিয়ে, লাঠি-গুলি খেয়ে।
নৈমিত্তিক শৃঙ্খলামাফিক চালাতে গেলে ‘ক্রেয়ন’-দের প্রশাসনিক যুক্তিকে শেষ পর্যন্ত নির্মম ও অকাট্য হতেই হবে। ১৯৬৫ সালে ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে ক্লাসরুমের চৌহদ্দিতে পুলিশ ঢুকে ছাত্র ভূদেব রায়কে গুলি করে হত্যা করে। পরের দিন সারা কলকাতা ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল, পুলিশের সঙ্গে মারামারি করতে গিয়ে ছাত্ররা সে-দিন স্কটিশ চার্চ কলেজে ঢুকে ভাঙচুর করে, উভয় পক্ষেই পরিসরের সব সংযম সে-দিন অতিক্রান্ত হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে রাজ্যপাল ধর্মবীরের নির্দেশে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল হয়। পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়, ডিসেম্বরে উত্তরপাড়া পিয়ারীমোহন কলেজে সংসদের তরফে বিক্ষোভ সভা ও সমাবেশ ডাকা হয়। পুলিশ কলেজে ঢুকে বেধড়ক পেটায়, ছাত্ররাও যথেচ্ছ ঢিল-পাটকেল ছোড়ে। তখনই আদ্যন্ত গাঁধীবাদী মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা কি নব ব্রাহ্মণ যে গোলমাল করলে তাদের ঠেঙানো যাবে না?’ স্পষ্ট ভাষায় রাজধর্ম সে-দিন নাগরিক পরিসরে তার দণ্ডের সর্বেশ্বরতা জাহির করেছিল। বিপ্রতীপ চিত্রও আছে। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যক্ষ সনৎ কুমার বসু সারা রাত ঘেরাও হন। শেষ রাতে পুলিশ এসে কাউকে বুঝিয়ে, কাউকে ধাক্কা দিয়ে, দু’এক জনকে আধ ঘণ্টার জন্য গ্রেফতার করে অধ্যাপক সনৎ বসুকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। পরের দিন আমরা কলেজে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘কলেজে পুলিশ ডাকল কে, সনৎ বসু আবার কে, ওই সনৎ বসু নিপাত যাক।’ এর পরেই ছাত্র বহিষ্কার নীতির প্রতিবাদে হস্তক্ষেপ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার গোলাপচন্দ্র রায়চৌধুরিকে ঘেরাও করা হয়। আধ ঘণ্টা ধরে তিনি চেয়ারে নির্বিকার বসে ছিলেন। স্লোগান একটু থেমে গেলে তিনি ছাত্রদের কাছে তাঁর পছন্দমতো গান গাইবার ফরমায়েস করেছিলেন, গল্পও জুড়েছিলেন। চেয়ার ছেড়ে ওঠার নামগন্ধ ছিল না, পুলিশ ডাকা তো দূরস্থান। আমরাই রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম। অনেক দিন পরে গল্পসূত্রে গোলাপবাবু বলেছিলেন, ‘ঘেরাও, ধরনা, যে-কোনও প্রতিষ্ঠানে, যে-কোনও সময় হতে পারে, তৈরি থাকতেই হবে। তাই বলে কি নিজের নিয়ন্ত্রণের পরিসর অন্যের হাতে ছেড়ে দেব, পুলিশ কখন কী করবে তার ঠিকানা কী। ছাত্রদের আমরাই সামলাব, সেই জন্যই আমরা আছি।’
এই স্বরও পরিসরের উপর কর্তৃত্বের দখলদারি রাখার পক্ষে, তবে ব্যবহারের তরিকা একেবারে আলাদা। স্মৃতি কণ্ডূয়ন দেখায় যে, নিছক ভাল-মন্দ নয়, নাগরিক তথা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের কর্তৃত্ব ও গণপ্রসারণের প্রশ্ন বরাবরই টানাপড়েনের বিষয়, রাজনীতির দোলনে দীর্ণ। অবশ্যই পরিসরের উপর নিয়ন্ত্রণের চরিত্র গত শতকের আশির দশক থেকে পাল্টাতে শুরু করে, সঙ্গে সঙ্গে নারীবাদী আন্দোলন, পরিবেশবাদী আন্দোলন প্রতিষ্ঠানে তাদের স্বতন্ত্র দাবিতে সরব হয়। সমস্ত রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণার প্রেক্ষিতে বামফ্রন্ট সরকার বন্দিহত্যা ও নির্যাতনের জন্য তদন্তের জন্য গড়া হরতোষ চক্রবর্তী কমিশনের কাজ স্থগিত রেখে দেয়। তার পর টানাপড়েনের অসংখ্য ছোট-বড় ঘটনা, মরিচঝাঁপি ও নন্দীগ্রামে গুলিচালনা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসু-র ক্যাম্পাসে পুলিশি নিগ্রহ। এমনকী মানবাধিকার রক্ষার খোলামেলা আলোচনায় বেমক্কা প্রশ্ন করার জন্য প্রশ্নকর্তাকে তরুণ তথ্যমন্ত্রীর সামনে বেধড়ক পেটানো হয়, নিরীহ শ্রোতা মৈত্রেয় ঘটকও রেহাই পান না। সরকারের চোখে সেটি ছোট ঘটনা, কয়েকটি নকশালের হুজ্জত-মাত্র ছিল। ২০ সেপ্টেম্বরের নতুন স্লোগানে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কর্মী হিসেবে সাড়া দিয়েছিলাম, ‘আলিমুদ্দিন শুকিয়ে কাঠ’। পরিসরের দখলদারি কারও নিরঙ্কুশ থাকে না। দড়ি টানাটানি চলতেই থাকে।
নিধিরামদের কাছে অতীত মাঝে মাঝেই ফিরে বর্তমান হয়ে ওঠে। ছত্রধর মাহাতো, রাজা সরখেলের মতো গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কর্মীরা আজও জেলে, শত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও নয়া জমানার সরকার তাদের জামিনে ছাড়া দিতেও নারাজ, ফলে একটার পর একটা সাজানো মামলায় বেকসুর ছাড়া পেয়ে আইনি প্যাঁচে তারা জেলে। বিপরীতে পুলিশ পিটিয়ে বা জঘন্য প্ররোচনামূলক হুমকি দিয়ে শাসক দলের প্রতিনিধিরা প্রশাসনিক মদতে তাঁদের রাজ্যপাট চালাচ্ছেন। রাজনৈতিক বন্দির অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য আইন হয়েছে, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কাজকর্ম আপাতত ঠান্ডাঘরে। এই সব অবশ্য ছোট ঘটনা। তবে নন্দীগ্রাম গণ-আন্দোলন দমনে পুলিশ পাঠানো ও গুলিচালানোর নৈতিক দায়িত্ব বর্তেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপর। তিনিই তখন পুলিশমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সেই যুক্তিতেই ছাত্রছাত্রী ধরনার উপর রোবট-সদৃশ কমান্ডো-বাহিনী পাঠিয়ে নিগ্রহ করার নৈতিক দায়িত্ব একদা ছাত্রছাত্রী আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরই বর্তায়। তিনিই বর্তমানে একাধারে পুলিশমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। সে-দিন রাজপথের পরিসরে স্লোগানের শব্দটি স্পষ্ট শুনেছিলাম, ‘সামনে শত্রু কালীঘাট’।
‘দলদাসতন্ত্র’ ও স্বৈরতন্ত্রের আবর্তনে পাক খেতে খেতে নিধিরামরা দেখে তাদের গলায় নতুন প্রতর্কের ফাঁস জড়িয়ে গেছে, নানা অভিঘাতকে এক পাটোয়ারি ধোপদুরস্ত মাজাঘষা ধাঁচ দেওয়ার খেলা চলেছে। এটি মূলত ছাত্র আন্দোলন, ছাত্ররা বেশির ভাগ গড্ডল, ভেড়ার পাল, সুযোগসন্ধানীদের উস্কানি-উন্মাদনায় বুদ্ধি বিকিয়ে দেয় এই রকম দারোগাসুলভ রিপোর্ট সমাজবিজ্ঞানীরা দিয়ে বসেছেন। প্রাক্তন নেতা বলেন যে, ছাত্ররা শুদ্ধমনা ও আবেগপ্রবণ, যেন আবেগের মধ্যে যুক্তি থাকে না, যেন সভাসমিতিতে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত পড়ুয়া নাগরিকরা তর্কবিতর্কে পথ বেছে নিতে স্বভাববিমুখ। ‘বহিরাগত’ বা ‘আবেগপ্রবণ’ যে-কোনও বর্গ চাপিয়ে দিতে পারলে কেল্লা ফতে, চটজলদি দাওয়াই মিলে যাবে।
আবার, আলোচনার ঝোঁকে, অভিভাবকসুলভ স্নেহে ও প্রাজ্ঞতার সূত্রে ছাত্রদের সামনে ‘কলকাতায় অনেকের প্রিয় দার্শনিক মিশেল ফুকোর কথা’ তুলে ধরা হয়। আন্দোলনের বাইরে ‘জ্ঞানার্জনের আনন্দ’ও কি কম পাওয়া! শিক্ষায়তনে অধ্যয়নই তো তপস্যা। নিছক একটা উদাহরণ হিসেবে চিরসুহৃদ অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীর (‘এই সমস্যা সামলাতে...’, ৩০-৯) ওই বক্তব্যে গাঁইগুই করব না। তবে মনে আসে যে, জ্ঞানার্জনের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে আমাদের প্রিয় ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড টমসন সব গবেষণা ছেড়েছুড়ে দশ বছর ধরে পারমাণবিক যুদ্ধ ও অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছেন, সময় নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেননি। কিছু দিন ধরে নির্মলকুমার বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরির পাতা উল্টে যাচ্ছি। ছাত্র, গবেষক ও শিক্ষক নির্মলকুমার সময়ের ডাকে বার বার পড়াশোনা ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন, জনঅভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হচ্ছেন, জেলে থেকেই দেশ পরিচয়ের রসদ সংগ্রহ করছেন, ‘বিয়াল্লিশের বাংলা’ নামে বইটা তো লিখতে হবে। উদাহরণ অনেক রকমের হতে পারে। কোনটাকে সামনে আনব, বাছব, তা নির্ভর করে পরিস্থিতি ও নির্বাচকের অবস্থানের উপর। আন্দোলনে ভবিষ্যতের হরিপদ কেরানিরাও থাকতে পারেন, থেকেছেন, তাতেই বা কী?
বরং ভাববার কথা অন্যত্র। গণতান্ত্রিক পরিসরের উপর চাপ বাড়ছে। কী ভাবে প্রতিষ্ঠানে আমরা সাধারণরা ঢুকব, কী পরিচয়পত্র লাগবে, কোথায় দাঁড়িয়ে কী বক্তব্য রাখব, সেই সবের উপর অনুশাসন জারি চলছে। পরিসর ছোট হচ্ছে। বিতর্ক চলছে উন্নয়নপন্থী কানুননিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণবাদী বুদ্ধিজীবী ও উন্নয়নপন্থী উদারনৈতিক বিজ্ঞাননিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে: ধরনা সত্যাগ্রহ, বয়কট বা ঘেরাও কত দূর আইনসংগত, সীমাটা কোথায়?
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ তো সময়ের গণনায় একটামাত্র দিন। শোনা শব্দগুলি বোধের এক একটি ক্ষণিক মুহূর্ত। প্রতিষ্ঠান তার স্বাভাবিকতায় ফিরে যাবে, বোঝাপড়ার পাল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলিশকঠোর দৈনন্দিনতায় নির্ধারিত হবে। ক্রেয়নের কাছে আন্তিগোনেরা ব্যবহারিক অর্থে হার মেনেই থাকে। কেবল আমার মতো নাগরিকের জীবন পরিসরে ওই দিনের অভিজ্ঞতাটা ‘লিমিনাল’ বা অতিক্রান্তির এক পলক হয়ে থেকে যাবে। কারণ, জানব যে, সে-দিন মিছিলে থাকা কেউ-না-কেউ এই লেখাটা পড়ে মনে মনে সেই শব্দবন্ধটি একটু বদলে উচ্চারণ করছে, ‘বাজে লেখকের প্রাপ্তি-যোগ, তার মাথাতে উকুন হোক।’