দায়িত্ব। রাজপথে প্রধানমন্ত্রী মোদী, নয়াদিল্লি, ২৬ জানুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
প্রায় প্রতি ছাব্বিশে জানুয়ারি কোথাও না কোথাও থেকে প্রশ্নটা কানে আসবেই। এ বছর ওডিশাবাসী এক তরুণ গাড়িচালকের মুখে শোনা গেল সেই জিজ্ঞাসা: আচ্ছা, ‘রিপাবলিক’ কথাটার মানে কী? সাধারণ মানুষ ‘রাষ্ট্র’ তৈরি করে, অর্থাত্ ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করে, এ তো গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবেই জানা কথা। তার উপর আবার প্রজাতন্ত্র কেন? রাজার বিপরীত শব্দই তো প্রজা, তার মানে, যে সব দেশ রাজ-শাসিত নয়, সেগুলোই প্রজাতন্ত্র। তবে তো গণতন্ত্র বলতেই বোঝা যায় যে রাজা-রানি এই দেশে অমিল। তার উপর আবার আর একটা নতুন শব্দ কেন?
প্রতি বছর প্রশ্নটা এক, উত্তরটাও এক। তবু কি এ বছর প্রশ্নোত্তরের পরিবেশটা একটু আলাদা? ‘রিপাবলিকান’ দেশ শব্দটার মধ্যে যে আসলে রাজা-প্রজা বাদ দিয়েও একটা আলাদা কথা আছে, কেবল ভোট দিয়ে সরকার তৈরি-র ব্যাপার নয়, সব রকম সরকারের উপরে যে ‘রাষ্ট্র’, সেটাই যে আসলে জনসাধারণের, সব সাধারণের সম্পত্তি, সেখানেই যে এ দেশের সব মানুষের সমতা ও দায়িত্বের নির্দেশ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-অধিকারের চূড়ান্ত স্বীকৃতি: এই সব চেনাশোনা কথাগুলো ভাবতে গিয়ে মনে হল, ২০১৫ সালের প্রজাতান্ত্রিক দিবসটা যেন খানিক তির্যকতায় আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দিল্লির রাজপথে উদ্যাপনের তুঙ্গ সমারোহে তুষ্টি হচ্ছে দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের, কিন্তু তাঁদের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার পিছনকার বিপুল আঁধারের দেশ থেকে ভেসে আসছে ওই রকম একটা ভর্ত্সনা আর যন্ত্রণার দৃষ্টি।
এই রাষ্ট্র দেশের সব মানুষের সম্পত্তি: ‘প্রজাতন্ত্র’ কথাটি যখন এই অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন আসলে বলার চেষ্টা হয় যে, এর মধ্যে সকলের অধিকার ও দায়িত্ব প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার, সেটা গণতন্ত্রের অধিকারের চেয়ে অনেকখানি বড়। শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, সমাজ, সব কিছুর ঊর্ধ্বে ব্যক্তির সেই অধিকার দাবি করে যে, সব নাগরিককে রাষ্ট্র সমান করে দেখবে, এবং সব নাগরিক রাষ্ট্রকে সমান করে কাছে পাবে। আমাদের সংবিধান-প্রণেতারা যে বিধ্বংসী দ্বন্দ্বদীর্ণতা ও হিংসাত্মক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও এই কথাটা ভাবতে পেরেছিলেন, সেটা সহজ ব্যাপার নয়। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র থাকার কী মূল্য, আমরা আজ তা পদে পদে ভুলে যাই। কিন্তু সে দিন তাঁদের বিশ্বাসের উপর ভর করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র যদি তৈরি না হত, তা হলে আমরা হয়তো আজ ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটা এই দেশে বসে আর কল্পনাও করতে পারতাম না!
ওই নেতারা আরও একটা কাজ করেছিলেন। কেবল নীতিতে নয়, ব্যবহারিক দেশগঠনের চেষ্টার মধ্যেও একটা কিছুর খোঁজ করেছিলেন, যেখানে সব রকম আইডেন্টিটি একত্র বসবাস করতে পারবে। নেহরুকে গালি দেওয়াটা উত্তর-আধুনিকতার বড় ফ্যাশন, কিন্তু মানতে হবে যে, সংবিধান-প্রণেতাদের ভাবনা তাঁর মধ্যে প্রত্যেক দিন প্রবাহিত হত, এমনকী অনেক রাষ্ট্রমাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে করতেও তিনি এই মৌলিক দায়টা মনে রাখতে পারতেন। এঁদের জন্যই সে দিন একটা ‘ভারত-ভাবনা’র পরিসর তৈরি হয়েছিল, যেখানে বিবাদ-বিসংবাদ-বৈষম্য থাকলেও তাদের সকলকে জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখতেই হত। নেহরুর রিপাবলিক ত্রুটিহীন ছিল না, শক্তপোক্তও ছিল না। কিন্তু শত সমালোচনা সত্ত্বেও, আজ এই ২০১৫-য় যখন নেহরু রিপাবলিক প্রায় অস্তে যেতে বসেছে, স্বীকার না করে উপায় নেই, সেই পুরনো ভারত-ভাবনা আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। তার খোলনলচে পাল্টে নতুন যে ভিন্ন ভারত-ভাবনার পরিপাটি বন্দোবস্ত, তাকে দেখে তীব্র আশঙ্কা হয়।
এই নতুন ভারত-ভাবনার একটিই রং, একটিই নাম, একটিই পথ, একটিই ধর্ম। অন্যরা নিশ্চিহ্ন না হয়ে গেলেও তাদের থাকতে হবে ছোট হয়ে, পাশে সরে, কোনও মতে। এই সরল কথাটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নতুন প্রধানমন্ত্রী ইদের প্রতীকী ইফতার-পার্টির ঐতিহ্য রাতারাতি বাতিল করে দেন, বড়দিনের উত্সবকে তিলমাত্র গণ্য না করে দিনটিকে ‘গুড-গভর্ন্যান্স ডে’ ঘোষণা করেন। টোকিয়ো গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে উপহার দেন ‘গীতা’। কেবল একটি সফরেই নয়, নিজ মুখেই বলেন, প্রতি সফরেই তিনি ওই একটি বইই সঙ্গে নেবেন উপহার হিসেবে। এই সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দেয় তাঁর উদ্দেশ্য ও বিধেয়।
এই অদ্বৈত-পন্থী ভারত-দর্শনে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং অন্যান্যের কোনও স্বীকৃতি নেই, প্রয়োজন নেই। ঠিকই, নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারে তেমন সংখ্যালঘু-বিরোধিতা শোনা যায়নি। কিন্তু সংখ্যালঘু-মরমিতাও এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হয়নি। তাঁর ২৮২ জন লোকসভা প্রতিনিধির মধ্যে এক জনও সংখ্যালঘু নেই। অতীতে প্রতীকী হিসেবেও দু-একটি ‘অন্য’ মুখ রাখার প্রচলন ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রতীকের খামখা ‘অপ’ব্যবহার করেননি। তাঁর সবটাই স্পষ্ট, স্বচ্ছ, সপাট। এক বারও সংখ্যালঘুদের লক্ষ করে তিনি কোনও বার্তা দেননি, এমনকী দাঙ্গার সময়েও না— ক্ষমতায় আসার আগে ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশে মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গার সময়েও নয়, ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪-র দিল্লির ত্রিলোকপুরী দাঙ্গার সময়েও না। এ সবে তিনি বিশ্বাস করেন না, ২০০২-দাঙ্গার ছাপ তাঁর পিছনে নাছোড় হয়ে লেগে থাকলেও তাঁর বিশেষ কিছু এসে যায় না। সংখ্যালঘুর প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁর ব্যক্ত বা অব্যক্ত অবস্থান একটিই: অর্থনীতির উন্নয়নেই সকলের উন্নয়ন। কিন্তু, তবে হিন্দুদের বিষয়ে এত আশঙ্কা কেন, কেনই বা তাঁর দলের তত্ত্বাবধানে একের পর এক সাংগঠনিক উদ্যোগ, শুদ্ধি কিংবা ‘ঘর ওয়পসি’, কিংবা হিন্দু পরিবারের সন্তানবৃদ্ধির নির্দেশ? উন্নয়ন মানেই তো সকলের উন্নতি? এ সব প্রশ্নের কোনও প্রয়োজন নেই। প্রশ্নের উত্তর তাঁর ভারত-ভাবনার ছত্রে ছত্রে প্রকট।
অনধিকার নির্মাণের তন্ত্র
এই যে নতুন ভারত-ভাবনা, যার ভিত্তি হল ‘মেজরিটারিয়ানিজম’ বা সংখ্যাগুরু-তন্ত্র— তা দিয়ে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক নীতিটি যে বিপন্ন হয়, সেটা পরিচিত কথা। কিন্তু আরও একটা কথা আছে। কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ‘প্রজাতন্ত্র’-এর ভাবনাটাও কিন্তু এর ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে! সংখ্যাগুরু-তন্ত্রের জোয়ার সংখ্যালঘু মানুষদের রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক পরিসর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তাদের চুপ করে যেতে বাধ্য করে। আস্তে আস্তে সমাজের এক বিরাট অংশকে অনধিকারী নাগরিক বানিয়ে দেয়। এই বছরের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনে সংখ্যালঘুরা যদি আগের মতো উত্সাহবোধ করেও থাকেন, তবে তার মধ্যে হয় অতীত অভ্যেস আছে, নয়তো আছে ভয়। মাত্র কয়েকটা মাসে যে অনধিকারের পরিবেশ তৈরি করে ফেলা গিয়েছে চতুর্দিকে, তাতে মুসলিম, খ্রিস্টান বা অন্যরা বিজেপিকে অতঃপর ভোট দেবেন কি না, সেটা অবান্তর হতে বসেছে, কেননা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অধিকারের অনেক আগে আসে এই প্রজাতান্ত্রিক অধিকার। প্রতি দিনের জীবনযাপনে যদি দেশের সঙ্গে এই ‘বিলঙ্গিং-নেস’ বা নিজস্বীকরণ না থাকে, তা হলে ভোটের ‘অধিকার’ তো কেবল পাঁচ বছর পর পর মাত্র একটি দিনের বাস্তব, কী এসে যায় তাতে। কেবল সেই একটি দিন সংখ্যালঘুরা নাগরিক। অন্য দিনগুলোয়, তাঁরা কেবল মহান ঐক্যময় জাতীয় জীবনের পার্শ্বচরিত্র, প্রায়শ প্রান্তিক।
এর মধ্যে যে প্রচণ্ড একটা অস্বীকার আছে, সেই কথাটা সংখ্যাগুরুতন্ত্র-বাদীরা কখনও বুঝবেন না। তাঁরা তো ‘অন্য’দের এই ‘নিজস্বীকরণ’-এর প্রচেষ্টাটাই বন্ধ করতে চান। তাঁদের কাছে অন্যদের জন্য গণতান্ত্রিক দায়টুকু রক্ষা করে যাওয়াই যথেষ্ট। এ ভারত তাঁদের। যারা এখানে জন্মেছে, সবাই তাই হিন্দু। যারা হিন্দু নয়, তারা কেন জন্মেছে কে জানে, কিন্তু হিন্দুস্তান তাদের যেটুকু যা দেবে, সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া গতি নেই।
জিয়নকাঠি
মোদীর সংখ্যাগুরুতন্ত্র-বাদী ভারত-দর্শন আকস্মিকও নয়, অপ্রত্যাশিতও নয়। ২০০২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তাঁর আত্মিক বা জাগতিক, যে পরিবর্তনই হয়ে থাকুক, তাতে সাম্প্রদায়িকতার উচ্চারণ একটু কমে থাকলেও সংখ্যাগুরুর জয়গান কখনও টাল খায়নি।
আর, এই কথাটার মধ্যে আছে অন্য একটা গভীরতর ভাবনা। সেটা গণতন্ত্রের ভাবনা। মোদী তো গত বছরের ১৬ মে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল জয়ের মধ্য দিয়েই একচ্ছত্র শাসন ভারতময় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তা হলে কি বলা যেতে পারে যে, নির্বাচনী গণতন্ত্র এই সংখ্যাগুরু-তন্ত্রকে জেনে বুঝে আদর করে ডেকে এনে দেশের ভার তার হাতে অর্পণ করেছে? অর্থাত্ গণতন্ত্রেরও কিছু দায় আছে প্রজাতন্ত্রের এই বিপদের পিছনে?
হ্যাঁ, তা আছে বইকী। শুধু নির্বাচনী গণতন্ত্র দিয়েই যে সর্বজনীন অধিকারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব না-ই হতে পারে, তার অনেক উদাহরণ ইতিহাসে ছড়ানো। ১৯৩৩ সালের জার্মানিতে হিটলারও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই অধিকারেই ঐতিহাসিক মারণযজ্ঞে নেমেছিলেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে শ্রীলঙ্কাতেও গণতন্ত্রের নামে সিংহলি সংখ্যাগুরুতন্ত্র স্থাপিত হয়, যার ফলে ১৯৮০ থেকে আড়াই দশক ধরে তামিল সংখ্যালঘুদের সঙ্গে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে উজাড় হয়ে যায় প্রায় গোটা দুটি তামিল প্রজন্ম।
তবে কি না, গণতন্ত্রের প্রকাশ তো কেবল নির্বাচনের অধিকারটুকুর মধ্যেই সীমিত নয়, নির্বাচন-উত্তর বা নির্বাচন-পূর্ব প্রাত্যহিক শাসনকাজের (গভর্ন্যান্স) মধ্যে, প্রতিষ্ঠানের চলনের মধ্যে, মুক্ত মতপ্রকাশ ও জীবনচর্যার মধ্যেও একটা গণতন্ত্র থাকার কথা। সেটার হাল কিন্তু বহু কাল ধরেই এ দেশে অত্যন্ত করুণ, রামচন্দ্র গুহ যে জন্য ভারতকে বলে থাকেন ‘পঞ্চাশ-পঞ্চাশ গণতন্ত্র’ (ফিফটি ফিফটি ডেমোক্র্যাসি)। গণতন্ত্রের এই পঞ্চাশ যদি একশো না হলেও আশি বা নব্বইতে পৌঁছয়, তা হলে প্রজাতন্ত্র বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার বিপদটাও কিছু কমে। কিন্তু গণতন্ত্র যদি কেবল নির্বাচনী গণতন্ত্রেই আটকে থাকে, সংখ্যাগুরু-তন্ত্রের ভয়ঙ্কর ভবিতব্য তাড়া করতেই পারে।
অর্থাত্, প্রজাতন্ত্রের মূল কথা যদি হয় অধিকার, তবে তার জিয়নকাঠিটা গণতন্ত্রের হাতেই। প্রত্যেক মানুষের সাম্য ও অধিকার রক্ষার কাজটা গণতন্ত্রের সত্যিকারের সার্থকতার উপর নির্ভর করবে। এ বারের ছাব্বিশে জানুয়ারি ওই ভাবনাটাই মাথায় ঘুরছিল। দিকে দিকে মোদীর নতুন ভারত-ভাবনার যা সদর্প উদ্যাপন— এর মধ্যে প্রজাতন্ত্রের সেই জিয়নকাঠিটা হারিয়ে বসবে না তো?