যখন ব্যঙ্গপত্রিকা ‘শার্লি এবদো’-র উপর অসহিষ্ণু ধর্মোন্মাদদের নৃশংস হত্যালীলার বিরুদ্ধে ধিক্কারে বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ, তখনই তামিলনাড়ুর নামাক্কাল জেলায় অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদীদের ধারাবাহিক আক্রমণ ও অপমানে এক সংবেদনশীল তামিল লেখক অভিমানে নিজের ‘মৃত্যু’ ঘোষণা করিলেন। এই মৃত্যু লেখক হিসাবে নিজের আত্মহননের ঘোষণা, যাহার দ্বারা পেরুমল মুরুগন তাঁহার এ যাবত্ প্রকাশিত যাবতীয় লেখালেখি ‘প্রত্যাহার’ করিলেন, প্রকাশকদেরও তাহা বিক্রয় করিতে মানা করিলেন। তাঁহার অভিমান অকারণ নয়। চার বছর আগে প্রকাশিত তাঁহার উপন্যাস ‘অন্য অংশ নারী’ (‘মাধরুভাগান’)-এ বর্ণিত একটি আখ্যান জেলার অনগ্রসর জাত কোঙ্গু ভেল্লালা-র মাতব্বরদের অপছন্দ হওয়ায় তাঁহাকে গত কিছু কাল যাবত্ চরম হেনস্থা করা হইতেছিল। ‘আপত্তিকর’ অংশটি উপন্যাস হইতে বাদ দেওয়া, ভবিষ্যতে বিতর্কিত কিছু না লেখার মুচলেকা দিয়াও তাঁহার রেহাই মেলে নাই। তাঁহার উপন্যাস পোড়ানো হয়, নামাক্কাল শহরে বন্ধ-ও পালিত হয়। জেলা-প্রশাসনও গোলযোগকারীদের পরিবর্তে লেখককেই আপস করিতে চাপ দেয়। অতঃপর এই সিদ্ধান্ত।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং গায়ের জোরে অপছন্দের মতকে চাপা দিবার কিংবা তাহার পোষণকারীদের দমন করার স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা কেবল যে শাসক শ্রেণিরই একচেটিয়া, তাহা নয়। যে-কোনও যূথবদ্ধ গোষ্ঠী সামাজিক স্তরে এই গুণ্ডামি অনুশীলন করিয়া চলে। পেরুমল মুরুগনের উপন্যাসে কাহাকেও আঘাত করার অভিপ্রায় ছিল না। নামাক্কাল জেলার তিরুচেঙ্গোদে শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তির পূজা-উপলক্ষে সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তানকামনার পরিপূরণে অপরিচিত পুরুষের সহিত সম্মত যৌন সংসর্গের যে পুরানো লোকাচার স্থানীয় ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত, তাহারই প্রেক্ষিতে এক সন্তানহীনা নারীর দ্বিধাদ্বন্দ্ব-দোলাচলের সংবেদনশীল চিত্রায়ণ ছিল। স্থানীয় সমাজপতিদের মনে হইয়াছে, পেরুমল মুরুগন তাঁহার উপন্যাসে এই গোপন লোকাচারের কথা প্রকাশ করিয়া অনগ্রসর জাতের সমাজকে অসম্মান করিয়াছেন। প্রায়শ্চিত্ত হিসাবেই তাঁহাকে বিতর্কিত অংশ বাদ দিতে হইবে। লক্ষণীয়, এই গোলমালের সহিত বিজেপি কিংবা আরএসএসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব কোনও ভাবে নিজেদের না জড়াইলেও তাহাদেরই স্থানীয় সংগঠনগুলি প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় থাকিয়াছে। জনসমাজে এই জাত-গর্বী অসহিষ্ণুরাই ক্রমে কেন্দ্রীয় শক্তি হইয়া উঠিতেছে। হিন্দু ভাবাবেগে আঘাতকারী কোনও লেখক তামিলনাড়ুতে থাকিতে পারিবে না, এই ঘোষণা শুনা যাইতেছে।
জেলা-প্রশাসন যে লেখককে নিরাপত্তা দিতে রাজি হয় নাই, তাহা বলিয়া দেয় যে উত্তরোত্তর দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিই সমাজ ও রাষ্ট্রের এজেন্ডা নির্ধারণ করিতে চলিয়াছে। আত্মপরিচয়ের রাজনীতির সংকীর্ণতাও প্রকট হইতেছে। অনগ্রসর জাতের রাজনৈতিক উত্থানের অনুঘটক হিসাবে সামাজিক মর্যাদার আন্দোলন জনগোষ্ঠীর আচরিত লোকাচারের বৈশিষ্ট্যগুলিকে অগোচরে রাখিতে মরিয়া হইয়াছে। দলিত/জনজাতির আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞান হিসাবে বহু ক্ষেত্রে কিন্তু বিভিন্ন আচরিত আচারই তুলিয়া ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু দলিতদের মধ্যে উচ্চ বর্ণের গোঁড়ামি ও অন্ধত্বকেই আঁকড়াইয়া ধরার দুর্ভাগ্যময় নজির প্রকাশিত। এই ঘটনা বিক্ষিপ্ত বা আপতিক নহে, বরং গুরুতর। ইতিহাসের একটি পাল্টা পাঠ ইহার মধ্যে লুকাইয়া আছে।