যাঁদের কথা রাষ্ট্র ঠিক মতো ভাবে না, সেই নির্বাসিতেরা ঠিক কী ভাবে বেঁচে থাকেন? এই প্রশ্ন নিয়ে প্রাক্তন আমলা হর্ষ মান্দার ও তাঁর গড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকুইটি স্টাডিজ প্রকাশ করলেন ইন্ডিয়া এক্সক্লুশন রিপোর্ট, ২০১৩-১৪। এঁদের আশা, এই নির্বাসন রিপোর্ট প্রতি বছরই প্রকাশিত হবে, নজরদারির বিষয়গুলি অবশ্য পাল্টে পাল্টে যাবে। (এক্সক্লুশন-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আপাতত নির্বাসন কথাটাই ব্যবহার করা যাক।) এ বছর তাঁরা নজর টেনেছেন, সরকারি যে-পরিষেবা পাওয়ার কথা ছিল যে জনগোষ্ঠীর, সেই পরিষেবা বা তার স্বত্বাধিকারগুলি কতটা রক্ষিত হয়েছে? সেগুলি থেকে কি কয়েকটি জনগোষ্ঠী সব সময়েই বাদ পড়েছেন? একটি পরিষেবা থেকে বাদ পড়া অন্য অনেকগুলি পরিষেবা বা স্বত্বাধিকার থেকেও তাঁদের বঞ্চিত করেছে। যিনি যথাযথ পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ হয়েছেন, বা পুনর্বাসন পেয়েছেন এমন জায়গায়, যেখান থেকে তাঁর পুরনো জীবিকা চালানো সম্ভব নয়, তাঁর ক্ষেত্রে কি সেই পুনর্বাসন তাঁর সন্তানের পড়াশুনোর সুযোগ কমাবে না? এই সব সুযোগ পাওয়ার বৃত্তে যাঁরা প্রবেশ করতে পারেননি, সেই বহিষ্কৃত বা নির্বাসিতদের নিয়েই এই প্রতিবেদন। দাম ৯৯৫ টাকা রাখা হলেও আন্তর্জালে বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে এই রিপোর্ট। সারা দেশে আলোচনা করে এই রিপোর্ট এঁরা প্রকাশ করছেন, কলকাতা শহর ছিল সেই যাত্রার আট নম্বর স্টপ, ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি কলকাতাবাসীর সঙ্গে ওঁরা এটি ভাগ করে নিলেন।
এ বারের রিপোর্টে বিদ্যালয় শিক্ষা, নাগরিক আবাসন, কাজের বাজার আর আইন ও বিচারের মাপকাঠিতে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের প্রয়োগ নিয়ে বিশেষ ভাবে আদিবাসী, দলিত, মুসলিম সম্প্রদায় ও মেয়েদের কথা এসেছে। এ ছাড়া সরকারি বাজেটের প্রক্রিয়ায় কতটা পাওয়ার ছিল এবং কী পাওয়া গেছে, তার বিশ্লেষণের সঙ্গে তিনটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে: রূপান্তরিত/রূপান্তরকামী, বন্ধুয়া মজদুর ও মুসহর। এই লেখায় আমাদের বিশেষ ভাবে মেয়েদের নির্বাসনের কথাই বলব, আগ্রহীরা বাকিটা দেখে নিতে পারেন।
দারিদ্র শতগুণনাশী। সারা দেশের নিরিখে গ্রামাঞ্চলে আদিবাসী মানুষরা সবচেয়ে দরিদ্র, শহরাঞ্চলে মুসলিমরা সবচেয়ে দরিদ্র। তার ছায়া পড়েছে স্কুলে ভর্তি না হওয়ার হারে: মেয়েদের মধ্যে একটু বেশি, দলিত ও মুসলিমদের মধ্যে আর একটু, আর প্রতিবন্ধী শিশুদের তিন জনে এক জন ইস্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়, এবং এখন সরকারি নির্দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের খবর রাখতে হয় বলে এইটুকু তথ্য পাওয়া যায়, আগে তাও যেত না। মাসিক মাথাপিছু ব্যয়ের নিরিখে সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ মানুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ, সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের ৯০ শতাংশ মানুষ সাক্ষর। শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলিতে এই পার্থক্য আরওই বাড়ে। যে বাচ্চারা ইস্কুলে যায়, তারাও পড়া চালাতে আগ্রহী হয় না। ৬৪তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষার উল্লেখ করেছে এই রিপোর্ট: গ্রামাঞ্চলে চার জনে এক জন আর শহরাঞ্চলে পাঁচ জনে এক জনে পড়া ভাল লাগে না বলে স্কুলছুট হয়, মেয়েদের মধ্যে এই কারণে স্কুলছুট অবশ্য একটু কম। যেখানে বহু গৃহহীন পরিবারের সঙ্গে শিশুটিকেও ঘুরতে হবে, উচ্ছেদ হতে হবে, সেখানে নতুন জায়গায় নতুন ভাষার স্কুলে গিয়ে আবার পড়া শুরুর কথা ভাবাই কঠিন। দেশের প্রায় ৪ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বাস করেন, যেখানে হাঁটাপথে কোনও ইস্কুল নেই। সেই শিশুরা কী ভাবে পাবে শিক্ষার অধিকার? সর্ব শিক্ষা অভিযানে বরাদ্দ অর্থের সুযোগ পেত দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাই, সেই বরাদ্দ খরচের হার কমেছে: ২০০৮ সালে ৭৭ শতাংশ ব্যয় হয়, ২০১০-১১ সালে ৬৯ শতাংশ। সংঘর্ষপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থা আরও খারাপ। সালবা জুড়ুম ছত্তীসগঢ়ে ১২০০০ কিশোরকে নিয়োগ করেছিল, আবার সরকার স্পেশাল পুলিশ অফিসার (এসপিও) বলে যাদের নিয়োগ করেছিল, তাদের অনেকের বয়স আঠারোর নীচে। কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও সশস্ত্র সংঘর্ষে কিশোরদের নিয়োগের বহু সাক্ষ্য রয়েছে।
মাথার উপর ছাদ সবার প্রয়োজন হলেও, আব্রুর কারণেই মেয়েদের জন্য তা আরও বেশি প্রয়োজন, এ আমরা জানতাম। এই রিপোর্ট আর একটু এগিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল যে, মেয়েদের মধ্যে কেবল ঘরে বসে কাজের সুযোগটাই বাড়ছে। এমনিতেই সংগঠিত শ্রমের বাজার সংকুচিত হয়ে এসেছে অনেক দিন আগেই, এমনকী নানা সংগঠিত ক্ষেত্রেও চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমের রেওয়াজ বেড়েছে, যা এক ধরনের অরক্ষিত শ্রমের বাজার, যেখানে ন্যূনতম মজুরি বা চিকিৎসার সুযোগ বা অন্য কোনও সুযোগ পাওয়া যায় না। মেয়েরা অনেক বেশি সংখ্যায় নিযুক্ত ছিলেন এই অসংগঠিত ক্ষেত্রেই। কিন্তু জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ৬৬তম রাউন্ড দেখাচ্ছে, মেয়েরা শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাচ্ছেন গৃহভিত্তিক কাজে: ঘরে বসে পাঁপড়, টিপ তৈরি থেকে বাল্ব-এর মাথা লাগানো বা অন্য বহু ধরনের উপাদান তৈরির কাজ। প্রচলিত ভাবনা এই যে, মেয়েরাই ঘরের কাজ করবেন, তার ফলে মেয়েরাও ঘরে বসে করার কাজ পেলে অনেক স্বস্তি পাচ্ছেন। কিন্তু যে-মেয়েরা ঘরে বসে কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগ শিক্ষা, জাতপাত, বয়স, মজুরির বা ফুরনের কাজের কাঠামোতে একই ধরনের কাজে নিযুক্ত পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি নাচার অবস্থায় থাকেন, অর্থাৎ তাঁদের দরাদরি করার ক্ষমতা কম। সেই সঙ্গে এই মেয়েরা হয়তো পারিবারিক হিংসারও শিকার। ফলে মুখ বুজে যে কোনও মূল্যে এই কাজটুকু ধরে রাখতে চান তাঁরা। এই মেয়েদের মাথার উপর ছাদের জন্য আরও বেশি করে ভাবার কথা বলছে এই রিপোর্ট। আর যে-মেয়েরা কাজের খোঁজে দূরে যেতে প্রস্তুত, তাঁদের জন্য নেই যথাযথ পরিবহণ, শৌচাগার বা ঘরের কাজের দায়িত্ব থেকে ছুটি। তাই রিপোর্টে উল্লেখিত সাত লক্ষ ঝুপড়িবাসীকে যখন দিল্লির উপান্তে পুনর্বাসিত করা হল, তখন আগে কাজ করতেন, এ রকম ২৭ শতাংশ মেয়ের কাজ গেল। কারণ, যাতায়াতের সময় বেড়েছে তিন গুণ। যেমন, কলকাতায় দেখেছি মেট্রো রেলের জন্য গড়িয়া থেকে উচ্ছেদ বা রবীন্দ্র সরোবর থেকে নোনাডাঙায় ‘পুনর্বাসনের’ পর বহু মেয়ে কাজ হারিয়েছিলেন: যাতায়াতের সময়, গাড়িভাড়া আর শৌচাগারের অভাব অনেককে বেকার করে দিয়েছিল অনেকেই বাবুদের বাড়ি কাজ করতেন আর বাবুবিবিরা তাঁদের বাড়ির শৌচাগার এই মেয়েদের দিয়ে পরিষ্কার করালেও ব্যবহার করতে দেন না।
বৈধব্য, স্বামী-আর-খোঁজ-রাখে-না বা অন্য নানা কারণে একটি মেয়েই বহু সময় কার্যত পরিবারের কর্তা হয়ে উঠেন। সে ধরনের পরিবারে দারিদ্র বেশি। সেই দারিদ্রের আর একটি প্রকাশ হল নারী-চালিত পরিবারের বাড়িগুলি কী দিয়ে বানানো, তার তথ্য। ২০১১ সালের জনগণনা এই নিয়ে পৃথক তথ্য বিশ্লেষণ করেছে, সেটা এই নির্বাসনের আর একটি দিক। এই গোত্রের পরিবারের ছাদ অনেক বেশি সংখ্যায় হাতে বানানো টালির, বা দেওয়াল মাটির বা না-পোড়ানো ইটের, অনেক কম বাড়িতে শৌচালয়ের ব্যবস্থা আছে। একলা মেয়েদের যে-পরিষেবা পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলি পেলে এটা হয়তো ঘটত না। তাই নির্বাসনের চাপ কমাতে রিপোর্ট উল্লেখ করেছে আমদাবাদ পুরসভার স্লাম নেটওয়ার্ক প্রোগ্রামের, যেখানে ঝুপড়িবাসীরা স্বত্ব পান না, কিন্তু উচ্ছেদ না-হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে।
ভারতে কাজের বাজার ক্রমশ আরও অসংগঠিত দিকে ঝুঁকছে, আমাদের দেশের মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ কোনও সুরক্ষিত কাজে যুক্ত আছেন, যেখানে তাঁর শ্রমিক/কর্মচারী হিসেবে কিছু অধিকার স্বীকৃত। তা হলে এই সরকারের কেন হঠাৎ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে শ্রম আইন সংশোধনের, সেটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। এই রিপোর্ট প্রশ্ন তুলছে, সবার জন্য বার্ধক্য ভাতার ব্যবস্থা কেন হবে না?
এই প্রশ্নটা মেয়েদের ক্ষেত্রে আরওই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মেয়েদের প্রত্যাশিত আয়ু ক্রমেই বাড়ছে, আর মেয়েরা বেশি করে অসংগঠিত ক্ষেত্রেই কাজ পাবেন, তাই বার্ধক্যের সমস্যাটা তাঁদের পক্ষে ক্রমশই বাড়বে। এমনকী সচ্ছল পরিবারেও বিধবারা বার্ধক্যে অনেক সময় প্রয়োজনীয় সহায়তা পান না, তাই বার্ধক্যের সুরক্ষার প্রস্তাবটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম অসম কাজের বাজারে সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারী, অধ্যাপক, শিক্ষক, ব্যাঙ্ককর্মী ইত্যাদিদের কেন সরকার এত বেশি বেতন দেবে, সেটা কেন কমানো হবে না, এই সব প্রশ্ন আজ পর্যন্ত কোনও বামপন্থী ইস্তাহার থেকে শুরু করে এই ধরনের সমাজদরদি রিপোর্টে কেন থাকে না, সেটা এক বিস্ময় বটে।
আইনের শাসনের নামে বিরোধীর কণ্ঠরোধ বা সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর হেফাজতে অত্যাচারের একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। যেমন আদিবাসী শিক্ষিকা সোনি সোরি-র পুলিশ হেফাজতে যৌননিগ্রহের ঘটনা বা ‘নকশালবাদী দমনের’ নামে পুলিশ হেফাজতে নিহত মীনা খালখো-র ঘটনা হতে পারে। সর্বসাধারণের জন্য সব দ্রব্য রাষ্ট্রকেই সুনিশ্চিত করতে হবে, নির্বাসিত জনগোষ্ঠীদের জন্য আরও একটু বেশি এগিয়ে এসে।