সম্পাদকীয় ১

যাদবপুর ২ : আত্মঘাতী

অভিজিত্‌ চক্রবর্তী ঠিক বলিয়াছেন। ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি তারিখটি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাজগতের ইতিহাসে ‘কালা দিবস’ হিসাবেই অ-বিস্মরণীয় হইবে। কিন্তু তাঁহার প্রতি অন্যায়ের কারণে নহে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সম্মানিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানির কারণে। বিদ্যায়তনের স্বক্ষমতাকে সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন বিবেচনাবর্জিত আধিপত্যকামিতার তাড়নায় লাঞ্ছিত করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কত বড় অন্যায় করিয়াছেন, তাহা এই স্তম্ভে ইতিপূর্বেই আলোচিত (‘কমলবনে’, ১৩-১)। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বলিয়াই তিনি এই কালা দিবসের প্রধান স্রষ্টা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

অভিজিত্‌ চক্রবর্তী ঠিক বলিয়াছেন। ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি তারিখটি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাজগতের ইতিহাসে ‘কালা দিবস’ হিসাবেই অ-বিস্মরণীয় হইবে। কিন্তু তাঁহার প্রতি অন্যায়ের কারণে নহে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সম্মানিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানির কারণে। বিদ্যায়তনের স্বক্ষমতাকে সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন বিবেচনাবর্জিত আধিপত্যকামিতার তাড়নায় লাঞ্ছিত করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কত বড় অন্যায় করিয়াছেন, তাহা এই স্তম্ভে ইতিপূর্বেই আলোচিত (‘কমলবনে’, ১৩-১)। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বলিয়াই তিনি এই কালা দিবসের প্রধান স্রষ্টা। কিন্তু সেই কলঙ্কে অভিজিত্‌বাবুর দায়ভাগও বিপুল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দূর করিবার স্বার্থে এবং আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘অন্যায়ের’ প্রতিবাদে তিনি সরিয়া যাইতেছেন, এই সিদ্ধান্তের পিছনে রাজনৈতিক কোনও চাপ নাই নিষ্কম্প কণ্ঠে তাঁহার এই আশ্চর্য উক্তি শুনিয়া কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ-এর কথা মনে পড়িতে পারে। ‘উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ’ কথাটি তাঁহারই সৃষ্টি। ১৬ সেপ্টেম্বরের সেই ভয়ানক মধ্যরাত্রির পরে চার মাস কাটিয়া গেল, যাদবপুরের কলরব রাজ্য এবং দেশের সীমানা অতিক্রম করিয়া আন্তর্জাতিক প্রতিধ্বনি তুলিল, অভিজিত্‌বাবু এত দিন নিভৃতে বসিয়া তাঁহার আহত আত্মমর্যাদার পবিত্র প্রতিবাদে তা দিতেছিলেন? সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা আবির্ভাব এবং তাঁহার সহিত আলাপের পরেই সেই প্রতিবাদী সত্তা তাহার দুই স্বাধীন ডানা মেলিয়া বাহির হইয়া পড়িল? দুর্জনে বলিবে: গল্পের গরু গাছে ওঠে জানা ছিল, সেই গাছের উচ্চতা যে এভারেস্ট ছাড়াইয়া যাইতে পারে, তাহা জানা ছিল না।

Advertisement

উপাচার্যের পদে বসিয়া অভিজিত্‌ চক্রবর্তী ক্রমাগত প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন যে, তিনি এই পদের যোগ্য ছিলেন না, তাঁহার পদত্যাগ-নাটিকাটিও সেই সত্যের নূতন প্রমাণ সরবরাহ করিল। এই অযোগ্যতার একটি গভীরতর কারণ থাকা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানান্বেষণের কেন্দ্র। সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের আসনে যিনি বসিবেন, তিনি যথার্থ জ্ঞানচর্চার ভুবন হইতে আসিবেন, ইহাই বিধেয়। উত্‌কৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সচরাচর এই রীতিই অনুসৃত হয়। অভিজিত্‌ চক্রবর্তী কারিগরি বিদ্যার পাঠ লইয়া কর্মজীবনে প্রবেশ করিয়াছেন। তাঁহার গবেষণাপত্র লইয়া যে সব প্রশ্ন উঠিয়াছে, সেগুলি যথেষ্ট অস্বস্তিকর, কিন্তু আপাতত তাহা উহ্য থাকুক। মূল কথাটি ইহাই যে, কারিগরি বিদ্যা যথার্থ জ্ঞানের অন্বেষণ নহে, অন্তত সাধারণ ভাবে এ দেশের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পঠনপাঠনে প্রযুক্তির প্রয়োগদক্ষতা অর্জনই লক্ষ্য, জ্ঞানচর্চা অন্য বস্তু। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রশিক্ষণ অবশ্যই মূল্যবান, কিন্তু তাহা ব্যবহারিক মূল্য, জ্ঞানের মূল্য নহে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি কারিগরি শিক্ষা দেয় না, তাহার জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট করা হয়, যাদবপুর সম্পর্কেও তেমন ভাবিবার যুক্তি আছে।

তাহার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, কারিগরি শিক্ষার দুনিয়া হইতে আসিলেই অভিজিত্‌ চক্রবর্তীর মতো আচরণ করিতে হইবে। ব্যক্তির ভূমিকা কতটা গুরুতর হইতে পারে, যাদবপুরের ঘটনা তাহা ভয়ানক ভাবে প্রমাণ করিয়াছে। কিন্তু ব্যক্তি আকাশ হইতে পড়ে না। যাঁহারা উপাচার্য নির্বাচন করেন, তাঁহাদেরও অত্যন্ত সতর্ক থাকা উচিত, কাহাকে তাঁহারা কোন আসনে বসাইতেছেন। আশা করা যায়, এই করুণ অভিজ্ঞতা হইতে তাঁহারাও প্রয়োজনীয় শিক্ষা লইবেন। আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি তাহার স্বমহিমা ফিরিয়া পাইবে। মর্যাদা হারাইতে সময় লাগে না, তাহার পুনরুদ্ধার অনেক বেশি কঠিন।

Advertisement

আগামী কাল: সাবধান

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement