সম্পাদকীয় ১

ভারতসুন্দরী

নারীর সৌন্দর্য লইয়া কবি-শিল্পী যতই উচ্ছ্বসিত হউন, তাহা এক অর্থে অর্থনীতির বিষয়। মহারাষ্ট্রে সমাজতত্ত্বের একটি পাঠ্যবই তাহা উল্লেখ করিয়া সম্প্রতি বিতর্কের মুখে পড়িয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

নারীর সৌন্দর্য লইয়া কবি-শিল্পী যতই উচ্ছ্বসিত হউন, তাহা এক অর্থে অর্থনীতির বিষয়। মহারাষ্ট্রে সমাজতত্ত্বের একটি পাঠ্যবই তাহা উল্লেখ করিয়া সম্প্রতি বিতর্কের মুখে পড়িয়াছে। দ্বাদশ শ্রেণির এই বইটিতে বলা হইয়াছে, কন্যা অসুন্দর হইলে বরপণ দাবি করা হয় অধিক, আর তাহা জুগাইতেও হয় বাবা-মাকে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, পাঠ্যে পণপ্রথা লইয়া সমালোচনার সুরটি ফোটে নাই। সৌন্দর্যের সহিত পণের সংযোগটি যেন মান্যতা পাইয়া গিয়াছে। অপরিণত মনে ইহার প্রভাব ভাল না-ও হইতে পারে। অপর পক্ষের আপত্তি, যাহা সত্য তাহা বলিলে ক্ষতি কী? উদারতার আড়ালে সাবেকি পুরুষতন্ত্রকে আড়াল করিতে শিক্ষিত ভারতীয় অভ্যস্ত। বরপণ যে সমাজের নিয়ম, তাহা স্বীকার করাই ভাল। এই বিতর্ক শিক্ষানীতির, ইহাতে সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ নাই। কিন্তু প্রশ্ন উঠিবে, অসুন্দর কে? এখানেও একটি অকথিত নিয়ম চলিয়া আসিতেছে। গাত্রবর্ণ, চোখমুখের গড়ন, দেহসৌষ্ঠব প্রভৃতি সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ধারণা হইতেই সৌন্দর্যের ধারণা প্রস্তুত হইয়া থাকে। যাহা প্রায় সম্পূর্ণই দৈহিক। বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক বা মানসিক গুণ দিয়া সৌন্দর্য সচরাচর বিবেচিত হয় না। তাই প্রায় জন্ম হইতেই কিছু মেয়ে ‘অসুন্দর’ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়া যায়, তাহাদের ‘সুন্দর’ হইয়া উঠিবার কোনও পথ থাকে না। ফর্সা হইবার ক্রিমের বিপুল বিক্রয় মেয়েদের সেই হতাশার প্রকাশ। পাত্রকে অধিক পণ বস্তুত ‘স্বল্পমূল্যের পণ্য’-এর জন্য বাড়তি ভর্তুকি। এই সনাতন ভারতীয় বিবেচনায় সৌন্দর্যের বিপরীতে সক্ষমতা। তাহা প্রতিটি মানুষকে অর্জন করিতে হয়। তাহার সাধনায় নারী-পুরুষ, রোগা-মোটা, গৌর-কৃষ্ণ সকলে সমান। কিন্তু বুদ্ধিমতী, উপার্জনক্ষম মেয়েরাও ‘প্রকৃত সুন্দরী’ না হইলে বিবাহের বাজারে ‘নিষ্প্রয়োজন’ হইয়া যায়। এই বিচারে নারীর সৌন্দর্য পুরুষতন্ত্রের হাতে এক শক্তিশালী অস্ত্র, যাহা অনায়াসে যে কোনও নারীর অমর্যাদা করিতে পারে। কেবল ভারতেই নয়, পাশ্চাত্যেও বহু নারী সৌন্দর্যের সংজ্ঞা মানিতে গিয়া অতি-কৃশ, অতি-দুর্বল হইতেছেন।

Advertisement

ইহার একটি বিপরীত ধারাও সম্প্রতি দেখা গিয়াছে। বীরভূমের প্রত্যন্ত এলাকা দেবানন্দপুরের কিছু তরুণী নিজেদের তৈরি পোশাকের বিজ্ঞাপন করিতে নিজেরাই ‘মডেল’ হইয়াছেন। এই তফসিলি জাতি ও জনজাতির তরুণীরা তাঁহাদের স্বাভাবিক সুষমাকে কৃত্রিম প্রলেপ-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত করেন নাই। ক্যামেরার সম্মুখে তাঁহাদের এই যাত্রা এই তরুণীদের বাড়তি প্রত্যয়ও দিয়াছে। সৌন্দর্যের এই পুরুষতন্ত্র-নির্দিষ্ট সংজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছে এই মেয়েরা, তাহাদের অন্তরের তাগিদে। ইহার পূর্বে অ্যাসিড-আক্রান্ত মহিলারাও এমন ভাবে ফ্যাশন প্রদর্শনীতে মডেল হিসাবে অবতীর্ণ হইয়াছেন। বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নারীও নির্ণয় করিতে পারে। যাহার মুখ পুরুষের হিংসার চিহ্ন বহন করিতেছে, তাহার ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক দৃঢ়তা কি অপরূপ নহে?

নারীর সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করিয়া নিজের ভাগ্য জয় করিবার অধিকার দাবি করিতেছেন মেয়েরা। ইহা পুরুষতন্ত্রের উপর আঘাত, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। ইহাতে একটু কৌতুকও প্রচ্ছন্ন আছে। পুরুষতন্ত্র বরাবর শিখাইয়াছে, বিবাহ ও সংসারেই নারীর সম্মান। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় স্বল্পবসনা মেয়েদের দেহ প্রদর্শন নারীত্বের অবমাননা। আজ ক্রমশ স্পষ্ট হইতেছে, বিবাহের শর্তগুলিও কম অসম্মানের নহে। আর ফ্যাশন প্রদর্শনীর মঞ্চ সৌন্দর্য ও সক্ষমতাকে এক করিয়া নারীকে অদ্বিতীয়া করিতে পারে। বীরভূমের দরিদ্র মেয়েরা প্রত্যয়ী প্রয়াসে সমাজতত্ত্বের নূতন পাঠ্য লিখিতেছেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement