সন্ধিক্ষণ। বিহারের নতুন মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঞ্জি ও তাঁর সদ্য-পূর্বসূরি নীতীশ কুমার।
১৬ মে-র পর থেকে নরেন্দ্র মোদীর বিজয়রথের ধ্বজাই একমাত্র দৃশ্যমান। গোটা দেশ জুড়ে তিনি যে প্রচার চালিয়েছিলেন, তার একটি বিশেষ চরিত্রলক্ষণ ছিল— সেই প্রচার এই নির্বাচনকে পরিণত করেছিল মোদীর গ্রহণযোগ্যতার গণভোটে। ফলে, যে আঞ্চলিক বা সামাজিক প্রশ্নগুলোর মধ্যে ধরা থাকে ভারতীয় গণতন্ত্রের বহুত্বের চরিত্রনির্যাস, সেই প্রশ্নগুলো এই নির্বাচনে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। সেই অর্থে, বিহারেরই সবচেয়ে ক্ষতি হল। গত এক দশক জুড়ে বিহারের ‘পুনর্জন্ম’-এর যে আখ্যানটি তৈরি হয়েছিল, তা জাতীয় নির্বাচনের আলোচনার পরিসর থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদী যে বিপুল জনাদেশে বলীয়ান হয়ে দিল্লির মসনদে বসছেন, তাতে রাজ্যগুলির স্বার্থহানির মাধ্যমে কেন্দ্রের শক্তিবৃদ্ধি তো হবেই, এ বার কর্পোরেট দুনিয়াই অর্থনীতির চালকের আসনে বসবে।
লোকসভা নির্বাচন বিহারের রাজনীতিতেও বিপুল তরঙ্গ তুলেছে। লালুপ্রসাদ যাদবের নেতৃত্বে ইউপিএ আগের আসনসংখ্যা ধরে রাখতে পেরেছে বটে, সংযুক্ত জনতা দল একেবারে ধরাশায়ী হয়েছে। নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর সাংবাদিক সম্মেলনে যে কথাগুলি বললেন, তাতে স্পষ্ট— বিজেপি-র সঙ্গে জোট ভাঙার সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, তাঁর আপত্তি আদর্শগত। নীতীশ বললেন, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর থেকে বিহারে ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা কার্যত অদৃষ্টপূর্ব। বিহারে ভারতীয় জনতা পার্টির এই জয় মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের একজোট হওয়ার ফল।
নরেন্দ্র মোদী এনডিএ-র মুখ হলে ভারতীয় রাজনীতি কোন পথে যাবে, সে বিষয়ে নীতীশ যা বলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবে, তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্তটি বিরোধীদের সম্পূর্ণ স্তম্ভিত করে তাদের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছে। ভারতীয় রাজনীতি এবং প্রশাসন থেকে যে নৈতিকতা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল, অনুমান করছি, নীতীশ কুমারের পদত্যাগ তা ফিরিয়ে আনতে পারবে। নীতীশ নিজে সরে গিয়ে এক মহাদলিত, জিতনরাম মাঞ্জিকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন। নীতীশ গত আট বছর ধরেই মহাদলিতদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এক দিকে পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুস্হররা অনেক সামনে আসতে পেরেছেন। অন্য দিকে, আরও একটি সরকারি নির্দেশে এখন বিহারে প্রত্যেক স্বাধীনতা দিবসে, প্রজাতন্ত্র দিবসে পঞ্চায়েতে জাতীয় পতাকা তোলেন কোনও না কোনও মুস্হর। জিতনরাম মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় মহাদলিতদের ক্ষমতায়নের পথে আরও এক পা হাঁটল বিহার।
২০০৫ সালে নীতীশ কুমার যখন এনডিএ-র মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিহারে ক্ষমতায় আসেন, তিনি একটি ‘চরম বৈপরীত্যের জোট’ (কোয়ালিশন অব এক্সট্রিমস) তৈরি করেছিলেন। তাঁর সরকার যাতে সামাজিক ভাবে বিবিধ জাত এবং বিভিন্ন শ্রেণির সমর্থন পায়, তা নিশ্চিত করাই নীতীশের উদ্দেশ্য ছিল। এনডিএ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সেই জোটও ভেঙে পড়েছে। তার পর নীতীশ একটি ‘প্রতি-জোট’ তৈরির দিকে মন দিয়েছিলেন— সামাজিক ভাবে ক্ষমতাহীন শ্রেণির জোট। দৃশ্যতই, সেই ‘প্রতি-জোট’ দানা বাঁধেনি। অন্য দিকে, এনডিএ একটি বিকল্প ‘চরম বৈপরীত্যের জোট’ তৈরি করতে পেরেছে— রামবিলাস পাসোয়ান আর উপেন্দ্র কুশবহা যোগ দিয়েছেন বিজেপি-র সঙ্গে। তবে, বিহারের রাজনীতি ফের নতুন মোড় নিতে পারে। নীতীশ কুমার-লালুপ্রসাদ যাদব সম্ভবত উচ্চ অনগ্রসর শ্রেণি এবং অন্যান্য ক্ষমতাহীন সামাজিক শ্রেণির জোট তৈরি করতে পারবেন। পারলে, বিহারের নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণে তার শক্তি নেহাত কম হবে না।
‘বৈপরীত্যের জোট’ নিয়ে কাজ করার বাধ্যবাধকতায় নীতীশ আগাগোড়া আর্থিক শ্রেণির প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষত ভূমি সংস্কারের প্রশ্ন। কিন্তু, নীতীশ তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম দফায় যখন পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনগ্রসর শ্রেণির মহিলাদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন, জোটের গায়ে তার আঁচ লেগেছিল। লালুপ্রসাদ যাদবের আমল থেকেই বিহারে ‘সামাজিক ন্যায়’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল। নীতীশের সংরক্ষণের সিদ্ধান্তটি সেই পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে চিরাচরিত উচ্চবর্গের আধিপত্যে ধাক্কা দিয়েছিল। পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানে এই ইতিবাচক সংরক্ষণের সিদ্ধান্তটি নীতীশের সরকারের শ্রেণি-জাত নিরপেক্ষতার নীতি থেকে প্রথম বিচ্যুতি। যে চিরাচরিত এলিট শ্রেণি নীতীশকে সমর্থন করেছিল, তারা গোড়ায় লালুপ্রসাদ যাদবের প্রত্যাবর্তনের ভয়ে এই বিচ্যুতি মেনে নিয়েছিল বটে, কিন্তু নীতীশের দ্বিতীয় দফায় যখন এই সংরক্ষণের ফলগুলো স্পষ্ট হতে আরম্ভ করল, তখন তারা নীতীশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকল। তার ওপর, পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদের আধিপত্য বাড়ার ফলে সমাজের নীচের দিকের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলিতেও উচ্চবর্গের আধিপত্যে ধাক্কা লাগল। ফলে, ‘বৈপরীত্যের জোট’ আর টিকল না। নীতীশ যখন এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করলেন, তখন সেটা মূলত এই বাস্তবেরই স্বীকৃতি। তৃণমূল স্তরে কোনও আন্দোলন ছাড়াই নীতীশ সমাজের নীচের তলার ক্ষমতাকেন্দ্রগুলিকে ওপর তলার আধিপত্য থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।
আগে সমাজের ওপর উচ্চবর্গের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল, কারণ গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ— আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগে তাদের প্রাধান্য ছিল প্রশ্নাতীত। নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে আইনবিভাগে উচ্চবর্গের আধিপত্য কমতে থাকে— নির্বাচনী রাজনীতির দৌলতে। তার পর থেকে, সামাজিক ন্যায়ের দাবিটিকে গুরুত্ব দিতে রাজনীতিকরা বিচারবিভাগ এবং প্রশাসনে নিম্নবর্গের জন্য খানিক জায়গা তৈরি করতে বাধ্য হন। মুঙ্গেরিলাল কমিশন এবং মণ্ডল কমিশন তৈরি হয়েছিল এই উদ্দেশ্যেই, কিন্তু তাদের প্রভাব মূলত স্বল্পমেয়াদি ছিল। কাজেই, বিহারে প্রশাসন এবং বিচারবিভাগে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর মূল পন্থাই ছিল এই শ্রেণির মানুষদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা। নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এই পথটিতে হাঁটতে চাননি। তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্তপোক্ত করার দিকেই মন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁর এই সিদ্ধান্তটি নিম্নবর্গের কাছে ভুল বার্তা দিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই সরকার আর সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বিহারে বিচারবিভাগ বা প্রশাসনের আধিকারিকদের জাত বা শ্রেণিগত অবস্থান বিচার করলে দেখা যাবে, বিভাগগুলির নীচের তলায় নিম্নবর্গের অনুপাত একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু, মানুষ অন্য প্রশ্নের উত্তর চায়। রাজ্যের মুখ্যসচিব কে? পুলিশের মহানির্দেশক কোন জাতের? এই প্রশ্নগুলো হয়তো অর্থহীন, কিন্তু এর উত্তরের ওপর নির্ভর করেই শাসনবিভাগ এবং সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানের বিচার করে মানুষ। এই প্রেক্ষিতে দেখলে, বিহারে শাসনযন্ত্রের ওপরের স্তরে নিম্নবর্গের উপস্থিতি খুবই কম, এবং সেটা নিম্নবর্গের মানুষের মর্মবেদনার কারণও বটে। ২০০৫ সালে নীতীশ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর রাজ্য প্রশাসনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই কর্তৃত্ব বিহারে প্রায় ছিল না বললেই চলে। নীতীশের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল, বিহার নামক রাজ্যটিকে দীর্ঘ অচলাবস্থার বাইরে নিয়ে আসা। প্রশাসনিক সক্রিয়তা প্রতিষ্ঠা না হলে উন্নয়নও সম্ভব নয়, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব। নীতীশ সেই কাজে অনেকখানি সফল হয়েছেন। যেমন, সাম্প্রতিক কালে বিহারে বিচার অনেক দ্রুত হয়েছে, অপরাধীদের শাস্তি দিতে সময় কম লাগছে। ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩-র জুন অবধি বিহারে ৮৩,০০০ অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। গোটা দেশের মধ্যে বিহারেই এই হার সর্বাধিক।
কিন্তু, এ ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। সামগ্রিক ভাবে যারা অপরাধ করছে, আর বিচারে যাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদের সামাজিক পরিচয়ে ফারাক আছে। দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিক ভাবে অপরাধীদের মধ্যে সমাজের সব স্তরের মানুষই আছে। কিন্তু, যারা শাস্তি পাচ্ছে, তারা মূলত মাঝারি বা নীচের শ্রেণির। শাসনযন্ত্রে উচ্চবর্গের আধিপত্যের কারণে একই অপরাধে উচ্চবর্গের মানুষের যে শাস্তি হচ্ছে, তার তুলনায় নিম্নবর্গের মানুষের শাস্তি হচ্ছে কঠিনতর। গ্রামাঞ্চলে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তরা— যাদের প্রায় সকলেই উচ্চবর্গের— যে রকম সহজে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, সেই উদাহরণের কথা মাথায় রাখলেই ছবিটা স্পষ্ট হবে। নীতীশ কুমারের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় এই ধরনের ঘটনা অনেকটা চোনা ফেলেছে। নির্বাচনে বিজেপি-র জয়জয়কারের পিছনে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজন ছাড়াও এটাও সম্ভবত বড় কারণ। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নীতীশ কতখানি আন্তরিক, নিম্নবর্গের মধ্যে তা নিয়ে সংশয় থেকে গিয়েছে।
তবে, নীতীশের পদত্যাগের সিদ্ধান্তটি ফের বিহারের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যে রাজনৈতিক শক্তিগুলি সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলে, এত দিন সেগুলো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। হয়তো আরও এক বার তারা জোট বাঁধতে পারে। লালুপ্রসাদ ইতিমধ্যেই সংযুক্ত জনতা দল সরকারকে সমর্থন জানিয়েছেন। বিহারে সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের দুই মূল প্রবক্তা নীতীশ ও লালুপ্রসাদ পরস্পর হাত ধরলে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক সমীকরণগুলি বদলে যেতে বাধ্য। এবং, সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রভাব সমগ্র হিন্দি বলয়ের ওপর পড়বে। সামাজিক ন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে জোট তৈরি হলে সেই জোট কোনও প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা ছাড়াই শ্রেণিগত প্রশ্নগুলির দিকে মন দিতে পারবে। এবং, সেই রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে নিম্নবর্গের নতুন একতা তৈরি হওয়া সম্ভব। সামাজিক ন্যায়-ভিত্তিক জোট কিন্তু রাজনীতির চিত্রনাট্যে নতুন মোচড় আনতে পারে।
পটনার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ সদস্য সচিব। মতামত ব্যক্তিগত।