সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীকে আরও এক দফা হতাশ করিলেন। প্রথমে তিনি ছয়টি পুরসভার নির্বাচন পিছাইতে সম্মত হন নাই। এখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি ছাড়িতে নারাজ। ইহাকে কৃতজ্ঞতাবোধ বলে? মুখ্যমন্ত্রী সব প্রথা ভাঙিয়া তাঁহাকে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসাইয়াছিলেন। নিশ্চয়ই আশা করিয়াছিলেন, সুশান্তরঞ্জন তাঁহার সুরে সুর মিলাইয়া সেই পদপ্রাপ্তির দাম চুকাইবেন। মুখ্যমন্ত্রীর আশাভঙ্গ হইতেছে। সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় প্রমাণ করিতেছেন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ক্ষমতার অলিন্দে তিনি বিরল গোত্রের মেরুদণ্ডী। মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় পদপ্রাপ্তি হইলেও তিনি তাঁহার সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হন নাই। তিনি যে তাঁহার পদটির যোগ্য, এই দ্বিতীয় বার প্রমাণ মিলিল। সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়রা গণতন্ত্রের বড় ভরসা। নিজেদের স্বার্থের ঘোলা জলে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ভাসাইয়া লইয়া যাইবার রাজনৈতিক প্রবণতা ঠেকাইতে পারেন তাঁহাদের ন্যায় আধিকারিকরাই। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর মন ভাঙিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গবাসী তাঁহার নিকট সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকিবে। নির্বিঘ্নে নির্বাচন করাইবার পথে রাজ্য সরকার যদি ফের বাধা হইয়া দাঁড়াইতে চাহে, কমিশনকে কঠোর থাকিতে হইবে। প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হইতে হইবে। কিন্তু, কোনও অবস্থাতেই নতিস্বীকার নহে। সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে দেখিয়া ভরসা জাগিতেছে, পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি কালীঘাটের মহানায়িকার খাসতালুক হইয়া উঠিতে এখনও বিলম্ব আছে।
রাজ্যের প্রশাসনকে দেখিয়া অবশ্য আশ্বস্ত হইবার কোনও উপায় নাই। ৫০ কম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি মানিয়া লইতে রাজ্য সরকারের আপত্তি দেখিলে কিছু অনুমান অনিবার্য। গত চার বত্সরে রাজ্য পুলিশ শাসক দলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত হইয়াছে। তাহাদের নিকট আর কেহ নিরপেক্ষতার আশা করেন না। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন এই নিরপেক্ষতার স্বার্থেই। রাজ্য সরকারের আপত্তি দেখিয়া কেহ ভাবিতেই পারেন, সরকারের বকলমে শাসক দল সেই নিরপেক্ষতা চাহে না। অনুমানটিকে উড়াইয়া দেওয়ার উপায় নাই। নিরপেক্ষতা এই সরকারের অভিজ্ঞান নহে। বস্তুত, সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে ফারাক থাকা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গে তাহার তিলমাত্র নাই। অতএব, নিরপেক্ষ কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি অগ্রাহ্য করিবার মধ্যে আরও এক দফা সিঁদুরে মেঘ দেখিবার যথেষ্ট কারণ আছে।
তর্কের খাতিরে যদি পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনকে নিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা হিসাবেই মানিয়া লওয়া যায়, তবুও প্রশ্ন ফুরায় না। রাজ্য নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই কমিশনটি গড়িতে পারেন, কিন্তু তাঁহার এক্তিয়ার সেখানেই ফুরাইয়া যায়। নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশনই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। কমিশন যাহা দাবি করিবে, তাহার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়াই রাজ্য সরকারের একমাত্র কাজ। কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন বোধ করিলে রাজ্যের কাজ তাহাতে সম্মত হওয়া। সরকারের সম্মতির প্রশ্নটি নিতান্তই আলঙ্কারিক হওয়া বিধেয়। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরা কোনও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বই স্বীকার করিতে নারাজ। নির্বাচন কমিশনের সহিত অসহযোগিতা, বিরোধ তাহার একটি প্রকাশ। অন্য দিকে, রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনের ন্যায় একটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ অকেজো পড়িয়া আছে। মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন এক সদ্য-প্রাক্তন পুলিশকর্তার হাতে মানবাধিকার রক্ষার ভার ন্যস্ত! মহিলা কমিশনের অবস্থাও তথৈবচ। এই প্রতিষ্ঠানগুলি অচল হইয়া যাওয়ার অর্থ, ক্ষমতাসীন দলের অপশাসনের পথে কিছু কাঁটা কমিয়া যাওয়া। সকলে যে সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় হইতে পারেন না। পারিলে, খেলাটি কালীঘাটের পক্ষে এত সহজ হইত না।