সম্পাদকীয় ১

বোর্ডই নিষিদ্ধ হউক

সেন্সর বোর্ড হইতে বহু সদস্য একযোগে পদত্যাগ করিলে কি গোটা সেন্সর বোর্ড জিনিসটিই খারিজ হইয়া যাইতে পারে? হায়, তেমন কোনও শুভ সম্ভাবনা বোধহয় নাই! তবে একটি বিষয় নিঃসন্দেহ। সাম্প্রতিক গণ-পদত্যাগের ফলে ভারতীয় সেন্সর বোর্ড-এর অর্থহীনতা ও উদ্দেশ্যহীনতা আরও এক বার উজ্জ্বল উদ্ভাসে ফুটিয়া উঠিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

সেন্সর বোর্ড হইতে বহু সদস্য একযোগে পদত্যাগ করিলে কি গোটা সেন্সর বোর্ড জিনিসটিই খারিজ হইয়া যাইতে পারে? হায়, তেমন কোনও শুভ সম্ভাবনা বোধহয় নাই! তবে একটি বিষয় নিঃসন্দেহ। সাম্প্রতিক গণ-পদত্যাগের ফলে ভারতীয় সেন্সর বোর্ড-এর অর্থহীনতা ও উদ্দেশ্যহীনতা আরও এক বার উজ্জ্বল উদ্ভাসে ফুটিয়া উঠিল। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বিভিন্ন আপত্তির বিভিন্ন কারণ খুঁজিয়া বাহির করাই ইহার প্রথম, থুড়ি, একমাত্র, কাজ। ভারতীয় সমাজ যেহেতু ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’, বালক-বালিকাদের যে পদ্ধতিতে সিনেমা দেখিতে বা বই পড়িতে দেওয়া হয়, এ দেশের আপামর জনসাধারণের প্রতিও সেই বিধিই প্রযোজ্য! সেন্সর বোর্ড অভিভাবকসুলভ তত্‌পরতায় দেখিয়া শুনিয়া বিচার করিয়া তবে দেশময় বালসাধারণকে অনুমতি দিয়া থাকে, কোনও সিনেমা আদৌ দেখা চলিবে কি না। সম্প্রতি ‘মেসেঞ্জার অব গড’ বলিয়া যে চলচ্চিত্রে দেরা সাচ্চা সওদা নামক গোষ্ঠীর গুরুবাদের দৈব মহিমা কীর্তিত হইয়াছে, তাহা লইয়া বিতর্কের জেরে নয় জন বোর্ড-সদস্য একসঙ্গে বোর্ড ছাড়িয়া দিলেন। তাঁহাদের অবর্তমানে যে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাইয়া হাজার কোটি ভারতবাসীর মস্তিষ্কধৌতি করিবে, দেশীয় সমাজ উত্‌সন্নে যাইবে, তাহা আটকানোর আর কোনও ব্যবস্থাই রাষ্ট্রের হাতে রহিল না, কী দুর্ভাগ্য!

Advertisement

প্রশ্ন একটিই। এবং সেটি অত্যন্ত গোলমেলে। এক হাতে নিষেধাজ্ঞা বিলাইব, অন্য হাতে নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখিব, এই মতবাদে কি দুর্বিপাকের সম্ভাবনা প্রভূত নয়? গণতান্ত্রিক দেশ তার সংবিধানমতে বাক্-স্বাধীনতার পূজারি, মুক্ত মতের অনুসারী। সেই মত কেবল পুঁথিগত, তাহাও বলা চলে না। চলচ্চিত্রে ধর্মীয় প্রতীকের পরিহাস বা সমালোচনা দেখিয়া রক্ষণশীল বর্গ সেই চলচ্চিত্র বন্ধের দাবিতে অগ্নিকাণ্ড বাধাইয়া বসিলে তাহাতে যদি বোর্ড কান না দেয়, তবে এ ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। বিদেশে ‘শার্লি এবদো’-র উপর আক্রমণের বিরুদ্ধেও যে যুক্তি, এ দেশের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও সেই যুক্তি: সহনশীলতা। কোনও চলচ্চিত্রে ধর্মীয় প্রতীকের অহেতুক গুণগান থাকিলেই সমাজ একেবারে ছারেখারে যাইবে, ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত হইবে, এমন ভাবিবার কোনও কারণ নাই। সমাজ তাহার নিজের শক্তিতেই এই ধরনের ভ্রান্ত বোধ কাটাইয়া উঠিবে। যদি না-পারে, তবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল্য হিসাবে তাহা মানিতে হইবে। তাই জ্যাঠামহাশয়গিরি ছাড়িয়া, সাহসে ভর করিয়া মুক্তির পরিসর তৈরি করা জরুরি। সুসংস্কৃতি কুসংস্কৃতি নির্বিশেষে সেই মুক্তির পরিসরকে বিরাজ করিতে দেওয়া জরুরি। আর, জরুরি কাজটি করিতে হইলে মনে রাখা ভাল, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তি সমাজে থাকিবেই। কিন্তু তাহাকে আটকাইবার জন্য মুক্তিটিকে আটকাইলে চলিবে না।

আমরা সেই মুক্তির পরিসর আটকাইব, নিজেরা যত্‌পরোনাস্তি মাথা গলাইব, আবার অন্যরা আমাদের কাজে কেন মাথা গলাইতেছে বলিয়া ঘ্যানঘ্যান করিব, পদত্যাগ করিব: ইহা বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক সেন্সর বোর্ডের কাজে মাথা ঘামাইয়াছেন কি না, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ এখনও অমিল। তবু যুক্তির খাতিরে বলিতে হয়, তাঁহারা মাথা ঘামাইলে ভুল করিয়াছেন, তাঁহাদের উচিত ছিল, বোর্ডটি তুলিয়া দেওয়া। দেশের বিবিধ অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য আইন আছে, সমস্যা উপস্থিত হইলে সেই আইনমতেই সিদ্ধান্ত লওয়া যায়। আলাদা একটি বোর্ড গঠন ও সদস্য নিয়োগ আসলে রাজনৈতিক দলাদলির প্রকৃষ্ট চারণক্ষেত্র। এমনকী, এই পদত্যাগের মধ্যেও রাজনীতির সেই দুষ্ট চক্রের ঘূর্ণনের ছায়া। এ সব ছাড়িয়া, সমাজ এবং রাষ্ট্র উভয়ই বয়ঃপ্রাপ্ত হউক। যে যাহার মতো চলুক। গণতন্ত্র সেই স্বাধীনতাই দাবি করে। ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বয়স পঁয়ষট্টি পূরণের চৌকাঠে। এখনও স্বাধীনতার দাবি মিটিবে না?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement