সরকারি টাকায় পার্টির আনুগত্য কিনিবার অনৌচিত্য লইয়া নূতন কথা বলিবার নাই। শূন্য রাজকোষের উপর বঙ্গেশ্বরী যত রকম অত্যাচার করেন, তাহার বেশির ভাগই বিপজ্জনক। ক্লাবে খয়রাতির বিপদটি অনেক ক্ষেত্রেই চোখ এড়াইয়া যায়, এবং সেই কারণেই এই বিপদের মাত্রাটি বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃহত্তম ব্যর্থতা, তিনি রাজনীতির তাড়নায় সমাজের বন্ধনসূত্রগুলিকে ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। তিনি থাকিবেন না, তাঁহার রাজনীতিও ইতিহাসের পাতায় মিলাইয়া যাইবে। তাঁহার উত্তরাধিকারের বিষাক্ত ঘা সর্বাঙ্গে লইয়া পড়িয়া থাকিবে হতভাগ্য পশ্চিমবঙ্গ। রাজকোষের টাকায় ক্লাব পোষণের সিদ্ধান্তটিও এই মর্মান্তিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। ক্লাব, বা স্থানীয় সংগঠনের ধারণাটি এই বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস বা সিপিআইএম-এর বহু পূর্ব হইতে আছে। এই সংগঠনগুলির মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হইত। শুধু শরীরচর্চা বা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ নহে, এলাকার মানুষের মধ্যে এক প্রকার আত্মীয়তা স্থাপিত হইত এই ক্লাবগুলির মাধ্যমে। গত শতকের প্রথম কয়েকটি দশকে যৌবন অতিবাহিত করিয়াছেন, এমন বহু মানুষের স্মৃতিকথায় সেই আত্মীয়তার মাহাত্ম্য ও মূল্য ধরা পড়িয়াছে।
সমাজের সর্ব স্তরের সব প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করিবার উদগ্র বামপন্থী বাসনায় গত জমানার শাসকরা এই ক্লাবগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বঙ্গেশ্বরী সেই প্রক্রিয়াটিকে নূতনতর উচ্চতায় লইয়া গিয়াছেন। এখন আর রাখঢাকের বালাই নাই। সরকারি টাকায় ক্লাবের আনুগত্য কেনা চলিতেছে। ক্লাবগুলি পার্টি অফিসে পরিণত হইয়াছে। তাহার আর কোনও সামাজিক চরিত্র নাই। ফলে, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বিপুল ভাবে হ্রাস পাইয়াছে। তাহাতে ক্লাবগুলির সামাজিক পরিচয় যেমন নষ্ট হইয়াছে, তেমনই বিভিন্ন সামাজিক প্রয়োজনে তাহার অংশীদারিত্বও প্রায় নাই। যে পরিসরে ক্লাবগুলি কাজ করিত, তাহা অবশ্যই গণপরিসর, কিন্তু সরকারি অধিকারের পরিসর নহে। তাহা প্রকৃত অর্থেই সামাজিক পরিসর ছিল। ক্লাবগুলি এই পরিসর হইতে অপসৃত হওয়ায় একটি শূন্যতা সৃষ্টি হইয়াছে। প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করিতে পারে না। ফলে, পরিসরটিতে এক দিকে রাজনৈতিক খবরদারি বাড়িতেছে, আর অন্য দিকে তাহা ক্রমে সরকারি প্রশাসনিকতার অন্তর্ভুক্ত হইতেছে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় একশত বত্সর পূর্বে বাংলার পল্লিসমাজে এমনই একটি প্রবণতার বাড়বাড়ন্তে আশঙ্কিত হইয়াছিলেন। তাঁহার আশঙ্কা ছিল, যাহাকে এ কালের ভাষায় ‘এজেন্সি’ বলা হইয়া থাকে, তাহা ক্রমেই সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হইতেছে। সামাজিক পরিসর হইতে ক্লাবগুলির হারাইয়া যাওয়া তেমনই এক বিপদ।
মুখ্যমন্ত্রী এত ভাবিয়া ক্লাবগুলিকে ‘কিনিয়া লওয়া’র সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, ততখানি আশঙ্কা হয় না। কিন্তু, সেই খরিদ্দারির ফলাফল তাঁহার মনোমত হইবে। তাঁহারা রাজনীতির চশমা ভিন্ন সমাজটিকে দেখিতে জানেন না। তাঁহাদের সেই চশমায় নাগরিক পরিসরের রাজনৈতিক পরিচিতিহীন জনসংগঠনের সদর্থক ভূমিকা ধরা পড়িবে না, বরং তাঁহারা সেই উপস্থিতিকে, আনুগত্যহীনতার কারণেই, বিপজ্জনক জ্ঞান করিবেন। তাঁহাদের নিয়ন্ত্রণ কাম্য। কাঞ্চনমূল্যে সেই অধিকার কিনিতে পারিলে আর গণপরিসরের প্রশ্নগুলি লইয়া ভাবিতে হয় না। তখন রাজনীতির চেনা ছকেই কাজ চলিয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, রাজনীতির যূপকাষ্ঠে সামাজিক পরিসরের বলি মানিয়া লওয়া ভিন্ন উপায়ান্তর নাই।