প্রবন্ধ ২

বাঘমারা পালোয়ান

আরে, দশ দিন পাবলিকের সামনে আসিনি, তাতেই পৃথিবী জুড়ে হইহই। লোকটা কি মোলো? কোনও রোগ ধরল? হাঃ, আমি কখনও মরতে পারি? এক্ষুনি বৈজ্ঞানিকগুলোকে যদি অর্ডার করি, ব্যাটরা উঠতে-পড়তে মাসতিনেকের মধ্যে অমরত্বের ক্যাপসুল বানিয়ে হাজির হবে না? এই তো সোচি-তে উইন্টার অলিম্পিক করলাম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

আরে, দশ দিন পাবলিকের সামনে আসিনি, তাতেই পৃথিবী জুড়ে হইহই। লোকটা কি মোলো? কোনও রোগ ধরল? হাঃ, আমি কখনও মরতে পারি? এক্ষুনি বৈজ্ঞানিকগুলোকে যদি অর্ডার করি, ব্যাটরা উঠতে-পড়তে মাসতিনেকের মধ্যে অমরত্বের ক্যাপসুল বানিয়ে হাজির হবে না? এই তো সোচি-তে উইন্টার অলিম্পিক করলাম। কত গেধো বলেছিল, ওখানে তো বেশি বরফই নেই স্যর, কী করে হবে? ওরে, তা হলে তো আমি সাধারণ একটা নেতা হলাম, ভগবানকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো মেগাক্ষম হলাম কই? বছর বছর গুদামে বরফ জমালাম, স্নো-মেশিন কিনে বরফ বানালাম! আমি যদি চাই, পঙ্গু গিরি লংঘিবে। এটাই আমার ভঙ্গি, বে!

Advertisement

আমাদের রাষ্ট্রের নায়কদের পদবির শেষে একটা ‘ইন’ থাকার চল আছে। লেনিন। স্তালিন। বা, একদম গোড়ায় যাঁর হাত আমার মাথার ওপর ছিল বলে পলিটিক্সে পাঁইপাঁই উঠলাম, ইয়েলত্‌সিন। কিন্তু আমি যা ‘ইন’, গোটা ইতিহাস আউট! ১৯৯৯-এ ক’দিন ছিলাম প্রধানমন্ত্রী, তার পর ইয়েলত্‌সিন হঠাত্‌ পদত্যাগ করতে হলাম অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট। তার পর ২০০০ থেকে ২০০৮ টানা আট বছর রাষ্ট্রপতি। তার পরও হতাম, কিন্তু গাড়লের মতো কিছু নিয়ম তো থাকে। সে নিয়মকে কলা দেখাতেও জানতে হয়। যে দিন রাষ্ট্রপতিত্ব ছাড়লাম, পরের দিন ফের হয়ে গেলাম প্রধানমন্ত্রী। ২০১২ অবধি। তার পর থেকে ফের রাষ্ট্রপতি। এই সকালে রাজা রাত্রে কিং খেলা চলতে থাকলে আগামী দুশো বছর কেউ সিংহাসনের আশি মাইলের মধ্যে আসবে না। হাসি পায়, যত বারই ভোটে জিতি, এক দঙ্গল লোক নামতার মতো চেল্লায় ‘রিগিং!’ মশামাছি! কারও ভাল দেখলেই নাকে ভনভনাবে। দেখছিস যখন জিতবই, কারও পিতৃদেব কিচ্ছু করতে পারবে না, শুধু শুধুু গলা চিরছিস কেন? ও গলা অবশ্য বেশি দিন ধড়ে থাকবে না।

২০০৬-এ একটা মহিলা কাগজে বহুত হাবিজাবি লিখছিল। এই সেনাবাহিনীর দুর্নীতি কথা ফাঁস করছে, ওই চেচনিয়া-য় তাদের নষ্টামির কথা লিখছে। তার পর, কী করে কে জানে, মেয়েটা নিজের বাড়ির সামনেই গুলি খেয়ে মোলো। ইন্টারভিউতে আমি বললাম, ‘ওর মরে যাওয়াটা ওর লেখার চেয়ে বেশি আমাদের ক্ষতি করবে।’ মানে, সাঁটে বলে দিলুম, না-মরলে, ওর লেখা নিয়ে কেউ মাথা ঘামতই না, বেটি এলেবেলে ছিল! আবার এই গত মাসে একটা বিরোধী দলনেতা, যে অনেক দিন ধরেই আমার নামে যা-তা তড়পাচ্ছিল, টাকা নয়-ছয় নিয়ে আমার ইয়ার-দোস্তদের সম্পর্কে অনেক কুকথা বলছিল, কী একটা নাকি রিপোর্টও তৈরি করছিল আমার কাজকম্ম নিয়ে বেচারা একটা ব্রিজের ওপর চারটে গুলি খেয়ে গেল। তক্ষুনি ডেথ। আমি বললাম, তদন্ত হবে। কে শোনে কার কথা, হুজুগ পেলেই হল। হাজারে হাজারে লোক জমায়েত হয়ে, ‘আমরা সবাই শার্লি’-র নকল করে ‘আমরা সবাই নেমত্‌সভ’ বলে শোর মচাচ্ছে! সবাই নেমত্‌সভ হলে সবাই গুলি গিলে সাধনোচিত ধামে কিতকিত খেলবি, আবার কী?

Advertisement

লোকে হয়তো ভেবেছিল ওই ব্রিজে গিয়ে গোমড়াপানা মুখ করে আমি নাইট্য নামাব। হাঃ, আমি কি দিদি নাকি, রানাঘাটে গিয়ে গাড়ির মধ্যে বসে কুলকুল ঘামছে? স্ট্রেট ধাঁ হলাম। এখন ফিরেছি। কেউ কিছু বললে, লৌহথাবড়া মারব!

তাই তো করে আসছি চিরকাল। দারুণ রেজাল্ট! এই সময়ে দাঁড়িয়ে, ইউরোপের একটা দেশে থেকে, আমি একটা জায়গার কিছুটা দিব্যি খাবলা মেরে দখল করে নিলাম! আমূল আত্তিলা-গিরি! সারা পৃথিবী জুড়ে কী কাঁউকাঁউ! ওবামা তো মুচ্ছো যায়! আমার বিরুদ্ধে এট্টু-আধটু ব্যবস্থা অবধি নেওয়া হল। কী হল? আমার টাকে জড়ুল গজাল? গুরু, রিয়েল মস্তান হতে জানতে হয়। যখন নিয়ম করলাম, হোমো প্রোপাগান্ডা আমার দেশে চলবে না, কত্ত প্রোটেস্ট! সোচি অলিম্পিকের আগে বললাম, হোমো অ্যাথলিটরা আসতে পারে, কিন্তু আমার দেশের বাচ্চাগুলোর দিকে কু-নজর যেন না দেয়, কত্ত লোকে নাকি অপমানিত হল। অলিম্পিক থামল?

ন্যাকামি আমার দু’চক্ষের বিষ, আর পাশ্চাত্যের সেরা আবিষ্কার হল এই পলিটিকাল কারেক্টনেস-এর ধাস্টামি। যত রাজ্যের পারভার্ট যা ইচ্ছে নোংরাবে, আর তাদের গোবেড়েন দেওয়া তো দূরস্থান, শালারা বেদিতে বসিয়ে পুজো করবে। বের্লুসকোনির বিরুদ্ধে এত মামলা, ওর ব্যভিচার নিয়ে ছিছিক্কার, কারণ ও মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে। এই যদি ছেলেদের নিয়ে বেলেল্লাপনা করত, সবাই হামলে পড়ে পায়ের চেটোয় চুমু খেত, বলত, মসিহা এয়েচেন। আমার দেশের সমাজ বীরের সমাজ, মিনমিন করে না। আমি অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট হয়েই কী ডিক্রিতে সই করলাম? কোনও বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বা তার পরিবারের কারও বিরুদ্ধে কক্ষনও দুর্নীতির অভিযোগ আনা যাবে না। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে এমন চমত্‌কার নিয়মটা লাগু করা যেত? হাবিজাবি ঘ্যানঘ্যান এসে ঔচিত্যের বাই তুলত। আমাদের সরল নীতি: দাপিয়ে চলো, পেশি দেখাও।

অবশ্য কোন প্রেসিডেন্টের পেশি এত বেশি যে র্যান্ডম দেখাবে? আমি তো সুযোগ পেলেই খালি-গা হয়ে দাঁইড়ে পড়ি! টাফ পুং! দেশকে বাঁচাতে এর চেয়ে দড় ক্যান্ডিডেট হয়? খালিগায়ে পাহাড়ে ছুটি কাটাচ্ছি, কনকনে সাইবেরিয়ার নদীতে সাঁতার কাটছি, ঘোড়া চড়ছি, তাপ্পর পোশাক পরে বাঘকে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ছি, পোলার বেয়ারকেও, মিলিটারি জেট চালাচ্ছি, স্কুবা-ডাইভিং করছি। আর জুডোয় তো আমি মাস্টার। বাম-পটকান আমার স্পেশালিটি। মাচো মাচো মাচো, আমায় ভোট দাও, কোনও মতে বাঁচো। এমনিতে আমি স্বয়ম্ভূ, বিশ্ব-জিনিয়াস, নো-রেয়াত ডন, শুধু এই খালি-গা স্ট্র্যাটেজিটায় এট্টু ঋণ থেকে গেল। তা, সলমন খান এ দেশে আসুন না, ওঁর সম্মানে ঘোর গ্রীষ্মে বরফ হুড়িয়ে দেব!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement