পরমাণু বিদ্যুত্ উত্পাদনে আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তির গিঁট খুলল বারাক ওবামার ভারত সফরে। তা নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস, অনেক শোরগোল হল। সে সব এখন থিতিয়েছে। এ বার একটু ঠান্ডা মাথায় দেখে নেওয়া যাক, এই গিঁট খোলার মানেটা ঠিক কী এবং পরমাণু বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষেত্রে এর কী ফল হতে পারে। চুক্তিটা হয়েছিল ছ’বছর আগে, ২০০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর। তা হলে গিঁটটা কোথায়? সেটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার। ভারত পরমাণু চুল্লি কিনবে আমেরিকার কোম্পানি থেকে, কিন্তু চুল্লিতে বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষেত্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে দায় বর্তাবে সেই কোম্পানির ওপর। এটা একান্ত ভারতীয় আইন (ইন্ডিয়ান সিভিল লায়াবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ অ্যাক্ট), যার প্রণয়ন ২০১০ সালে। ওই আইন কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে চালু নয়। বিশ্ব জুড়ে যে ব্যবস্থা চালু তা অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় চুল্লি সরবারহকারী কোম্পানির নয়, যে সংস্থা চুল্লি চালায় তার।
ভারতীয় আইন অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দায় তিরিশ কোটি মার্কিন ডলার আর চুল্লি যারা চালাবে, তাদের দায় ১৫০০ কোটি টাকা। ভারতে পরমাণু চুল্লি চালানোর সংস্থাটি হল নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (এনপিসিআইএল), যা পরমাণু শক্তি দফতরের অধীনস্থ।
২০১০ সালে প্রণীত আইনে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় চাপানোর ব্যাপারে বাছবিচার করা হয়নি। চুল্লি প্রস্তুতকারী সংস্থা যদি ভারতীয়ও হয়, তা হলেও দায়ভার তাদের। অবশ্য আইন প্রণয়নের আগে ভারতীয় চুল্লি প্রস্তুতকারীদের কোনও দায় বহন করতে হত না। প্রশ্নটা উঠল যখন থেকে বিদেশি চুল্লি কেনার ব্যাপারটা এল। বিদেশি কোম্পানিগুলো দেখল, ভারতীয় আইন তাদের পক্ষে বিপজ্জনক। ভারতীয় আইনের ১৭ নম্বর ধারাকে তাদের সবচেয়ে বেশি ভয়। তাদের ব্যাখ্যা, ওই ধারা অনুযায়ী দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের দায়ভার ব্যাপারটা বেশ অস্বচ্ছ, তা বহনের সময়সীমাও নির্দিষ্ট নয়, যে চুক্তিবলে চুল্লি কেনা হচ্ছে তাতে যা-ই লেখা থাকুক না কেন। সুতরাং বিদেশি কোম্পানিগুলোর দাবি ছিল, ব্যাপারটা খোলসা করতে হবে। এবং চুল্লি কেনাবেচার চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই একটা উপযোগী আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এ দাবি শুধু যে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ছিল তা নয়, যে সব ভারতীয় কোম্পানি প্রেশারাইজ্ড হেভি ওয়াটার রই্যাকটর বানায়, তারাও চেঁচামেচি শুরু করেছিল।
ফল? বেশ খানিকটা অচলাবস্থা। নতুন পরমাণু চুল্লি তো বটেই, এমনকী পুরনোগুলোর যন্ত্রাংশ বিক্রির ব্যাপারে দেশি এবং বিদেশি কোম্পানিগুলো বেঁকে বসছিল।
মুশকিল আসান হবে কী ভাবে? নেওয়া হল এক পদক্ষেপ। তৈরি হল ইন্ডিয়ান নিউক্লিয়ার ইনশিয়োরেন্স পুল (আইএনআইপি)। ভারতে সরকারি মালিকানাধীন চারটে বিমা সংস্থা যার সদস্য। ঠিক হল চুল্লি সরবারহকারী সংস্থা দেশি বা বিদেশি যা-ই হোক না কেন, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আর্থিক সুরক্ষা দেবে ওই পুল। আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, চিন, জাপান কিংবা ইংল্যান্ড-এ সুরক্ষার ও রকমই ব্যবস্থা।
বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ভারতে পরমাণু শক্তির সাহায্য দরকার। আর সে ক্ষেত্রে ভারতের উপযোগী দায়ভার বণ্টনের ব্যবস্থাও জরুরি। এ দিকে আইনও বদলানো যায় না। তা হলে এগিয়ে চলার পথ কী? পথ দেখাবে আইএনআইপি। ভাষ্যকারেরা কেউ কেউ সরব হয়েছেন এর বিরুদ্ধে। বলেছেন, আইএনআইপি নাকি ২০১০ সালে প্রণীত ভারতীয় আইনকে এড়িয়ে চলার ফন্দি, যাতে কিনা আমেরিকান কোম্পানিগুলো সুবিধে পায়। এই সমালোচনা ঠিক নয়।
আইনের ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, পরমাণু চুল্লিতে বিদ্যুত্ উত্পাদনের আগেই এনপিসিআইএল ১৫০০ কোটি টাকার বিমা করতে বাধ্য থাকবে। এটা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তার দায়। সুতরাং বিদেশ থেকে চুল্লি কেনা হোক কিংবা ভারতীয় কোম্পানি সেগুলো বানাক, পরমাণু বিদ্যুত্ উত্পাদন চালু রাখতে ওই ব্যবস্থা থাকছেই। এ দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়, এই ব্যবস্থায় ভারতীয় আইনকেই মানা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠবে, আইএনআইপি কেন তিন বছর আগে করা গঠন করা হয়নি? হ্যঁা, তিন বছর আগে ভারতীয় আইন বৈধতা পায়। তা ছাড়া, সন্ত্রাসবাদী হামলার মোকাবিলায় ও রকম একটা পুল-এর ব্যবস্থা ২০০২ সাল থেকেই ছিল। প্রথমত, পরমাণু বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষেত্রে বিমার ব্যাপারটা ভারতে বিমা ব্যবসায় একটা নতুন জিনিস। দ্বিতীয়ত, বিমা কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত দায়ভার বহন ক্ষমতাও এমন বেশি নয় যে, ওই ১৫০০ কোটি টাকার বোঝা তারা বইতে পারে। এটা অবশ্যই আইনের ঝামেলা।
এ দিকে আবার বিদেশি বিমা কোম্পানিগুলোকেও ভারতে সিংহভাগ অংশীদারি দেওয়া হয় না। এ কারণে পরমাণু চুল্লির ব্যাপারে বিমার অভিজ্ঞতা যে সব বিদেশি কোম্পানির, তারা এখানে বিনিয়োগ করতে চায় না। আলাদা করে বিদেশি বিমা কোম্পানির দ্বারস্থ হওয়াও চলে না, কারণ তা হলে তারা ভারতের পরমাণু চুল্লিগুলিতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কতটা, তা সরেজমিনে তদন্ত করবে। যে সম্ভাবনা ভারত বহু আগে থেকে বাতিল করে দিয়েছে। এ রকম নানা ফ্যাকড়ায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল।
যে চারটে ভারতীয় বিমা কোম্পানি মিলে তৈরি হয়েছে আইএনআইপি, তাদের মিলিত জোগান ৭৫০ কোটি টাকা। অথচ মোট বিমার পরিমাণ ১৫০০ কোটি টাকা। সুতরাং বাকি ৭৫০ কোটি টাকার দায় ভারত সরকারের। অবশ্য এটা এখনকার বন্দোবস্ত। চারটে কোম্পানির আর্থিক ক্ষমতা বাড়লে সরকারের বোঝা নিয়ম অনুযায়ী কমবে।
এনপিসিআইএল যে বিমার জন্য দেয় টাকার হিসেবটা পরমাণু চুল্লির দামের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেবে, তা না বললেও চলে। বোঝাই যাচ্ছে, তার ফলে পরমাণু বিদ্যুতের মাসুলও বাড়বে। তবে সে বৃদ্ধি সাংঘাতিক কিছু হবে না। আবার, আমেরিকার চুল্লি প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো যে আইএনআইপি দেখে ভারতের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী হবে তা-ও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ওই সব কোম্পানি পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার আর্থিক দায় নিতে কখনওই আগ্রহী ছিল না। নতুন ব্যবস্থাতেও তাদের ব্যবসার আগ্রহ যে বাড়বে, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এমনটা হতেই পারে যে, আইএনআইপি-ও তাদের অপছন্দ হবে।
অন্য দিকে, বিদেশি কোম্পানি যদি পরমাণু চুল্লির চড়া দাম হাঁকে, তা হলে ভারত সরকারও তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে। কারণ সে ক্ষেত্রে পরমাণু বিদ্যুতের মাসুল এক লাফে বেড়ে যাবে। তেমন হলে আসরে নামবে ভারতীয় কোম্পানি
শেষে সামান্য ইতিহাসচর্চা করা যাক। পরমাণু বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা কাটাতে পথ যে বের করতেই হবে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল মনমোহন সিংহ সরকার। টের পেয়ে পথের খোঁজও শুরু হয়েছিল। আইএনআইপি-র রূপরেখা তৈরি হয়েছিল ২০১১ সালে। মানে, মনমোহন সিংহ-র আমলে। তার পরে যা হয়, সরকারি দীর্ঘসূত্রিতা গ্রাস করেছিল গোটা ব্যাপারটাকে। রূপরেখা তৈরি হয়েও নতুন ব্যবস্থা রূপায়ণে কাজ হচ্ছিল না কোনও। মোদী সরকারের কৃতিত্ব আইএনআইপি-র ব্যাপারটা ত্বরান্বিত করায়। আর, বারাক ওবামা-র ভারত সফরকালেই আইএনআইপি তৈরি করে ফেলায়। রাজনৈতিক সুবিধে এর ফলে মিলছে, অবশ্যই। সেটা রাজনীতির ব্যাপার।