মহিন্দা রাজাপক্ষে নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন, গণতন্ত্রের মার কাহাকে বলে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে তাঁহার দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ফুরাইতে বছর দুই বাকি ছিল। কিন্তু তিনি আর অপেক্ষা করিতে চাহেন নাই। অপশাসন, পরিবারতন্ত্র, স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির পাশাপাশি তাঁহার দমননীতি ও স্বৈরাচার জনমনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত করিয়াছিল, তিনি হয়তো তাহার আঁচ পাইতেছিলেন। ভাবিয়াছিলেন, আগুন বাড়িবার আগেই আরও ছয় বছরের জন্য আসনটি পাকা করিয়া লইবেন। তদুপরি, তাঁহার দীর্ঘকালের পারিবারিক জ্যোতিষী, অধুনা রাজজ্যোতিষী সুমনদাস অভয়গুণবর্ধন পাঁজি দেখিয়া যে সুসময়ের আভাস দেন, তাহার ভরসাতেই সম্ভবত তিনি বুক বাঁধিয়াছিলেন। জ্যোতিষীর বচন মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে। রাজাপক্ষের রাজ্যপাট গেল, রাজজ্যোতিষীও কি আর তত অভয় রহিবেন? ভোটদাতারা যে বিপুল সংখ্যায় বুথে-বুথে লাইন দিয়াছিলেন, নিজেদের রায় জানাইতে তাঁহাদের মধ্যে যে প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়, তাহার মধ্যেই নিহিত ছিল পরিবর্তনের জন্য তাঁহাদের আকাঙ্ক্ষা। তাই পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষপাত ও বাধাদান সত্ত্বেও জনাদেশ রাজাপক্ষের বিদায়ঘণ্টা বাজাইয়া দেয়।
বিজয়ী প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রথমে নিছক বিক্ষুব্ধ রাজাপক্ষে-অনুগামী হইলেও কালক্রমে সম্মিলিত বিরোধী পক্ষের সর্বসম্মত প্রার্থী হইয়া ওঠেন। রনিল বিক্রমসিংঘে হইতে চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা, সব তাবড় রাজনীতিকই তাঁহার প্রার্থী-পদ সমর্থন করেন। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে রাজাপক্ষে পরিবার নিঃসঙ্গ হইয়া পড়ে। যে তামিল প্রতিরোধ ধ্বংস করিয়া দেশকে দ্বিখণ্ডনের সম্ভাবনা হইতে রক্ষা করার এক দফা কৃতিত্ব দাবি করিয়া এত কাল রাজাপক্ষে সিংহলি জাতীয়তাবাদ উস্কাইয়াছিলেন, তাহার আর খরিদ্দার মিলিতেছিল না। তামিলরা তো বাক্স ভরিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে ভোট দিয়াছেনই। সিংহলিরা, এমনকী বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভিক্ষুরা এবং তাঁহাদের অনুগামীরাও রাজাপক্ষের শাসনপদ্ধতি পছন্দ করিতেছিলেন না। ভোটের ফলে তাহারই প্রতিফলন ঘটিয়াছে।
নূতন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সামনে অবশ্য এখন কঠিন চড়াই। রাজাপক্ষে ধারাবাহিক ভাবে বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের উপর যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, তাহা ঘুচানো দরকার। সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও মর্যাদা ফিরাইয়া দেওয়াও আবশ্যক। এগুলিই শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সূচিত করিতে পারে। পরিবর্তন মানে কেবল এক প্রেসিডেন্টের বদলে অন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাসীন হওয়া নয়। শাসননীতিতে গণতান্ত্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনিতে না পারিলে তাহা আবার ব্যক্তিগত স্বৈরাচারের অভিমুখেই অগ্রসর হইবে। শ্রীলঙ্কার মূল সমস্যা সিংহলি-তামিল জাতিবৈর। তামিল গেরিলারা যুদ্ধে পরাভূত হইয়াছে বলিয়াই সেই বৈরিতার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে, এমন নয়। বস্তুত দ্বীপভূমির তামিলরা তত দিনই ইলম-এর স্বপ্ন সযত্নে লালন করিবেন, যত দিন তাঁহাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের গণতান্ত্রিক অধিকার সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ভাবে স্বীকৃত না হয়। সিরিসেনা যদি এই মূল প্রশ্নটি এড়াইয়া যান, তবে শ্রীলঙ্কার আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি খণ্ডিতই থাকিয়া যাইবে।