আশি অপেক্ষা চুয়াত্তর কম। সুতরাং অশীতিপর রঘুনাথ কুশারীর তুলনায় চুয়াত্তর বছরের নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় নবীনতর। সরল পাটিগণিত। অতএব দলের কলিকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক পদে রঘুনাথবাবুর স্থলে নিরঞ্জনবাবুকে বসাইয়া সিপিআইএম দাবি করিতেই পারে, তাহারা সবুজের অভিযান করিতেছে! ভারতীয় রাজনীতিতে বৃদ্ধতন্ত্রের জয়জয়কার কোনও অভিনব ঘটনা নয়। এখানে বার্ধক্য এবং নেতৃত্ব সমার্থক। নবীনের আনুগত্য আদায় করিতে হইলেও যথেষ্ট প্রবীণ না হইলে চলে না। তাই সব রাজনৈতিক দলেই নেতৃস্থানীয় পদে পক্বকেশের ছড়াছড়ি। কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল রাজীব গাঁধীর কংগ্রেস, অধুনা নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি। মোদীকেও লালকৃষ্ণ আডবাণী ও মুরলীমনোহর জোশীর ন্যায় নেতাদের দলীয় নেতৃপদ হইতে অপসারিত করিতে রীতিমত কাঠখড় পুড়াইতে হইয়াছিল। তবে বামপন্থী দলগুলিতে এ ধরনের কোনও ব্যতিক্রম নাই। কার্যত সব নেতাই অতিপ্রবীণ, অনেকে অশীতিপর, কেহ কেহ নবতিপর। বয়স কম হইলেও অন্তত চুয়াত্তর।
যে দল এখনও ১৯৭৮ সালের দলীয় লাইন ঠিক ছিল কি না, তাহা লইয়া আলোচনা-বিতর্কে সময় কাটাইতে ব্যস্ত, তাহার এমনই হইবার কথা। দীর্ঘ ছত্রিশ বছর আগে গৃহীত দলীয় লাইনের যাথার্থ্য লইয়া আলোচনাকে যাহারা প্রাসঙ্গিক মনে করে, তাহা লইয়া দলিল, পাল্টা-দলিল রচনা ও পেশ করিয়া তর্কে মাতিতে চায়, সেই দল আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ কেমন করিয়া সামাল দিবে? আজ যে পশ্চিমবঙ্গে এই দল ‘বিরোধী শক্তি’ হওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাও হাতছাড়া করিয়াছে, বিধানসভায় বিরোধী দল হইলেও রাজ্য-রাজনীতিতে তাহাকে লইয়া যে শাসকরা আদৌ ভাবিত নয়, তাহার একটি বড় কারণ দলের দুর্মর বৃদ্ধতন্ত্র। তরুণ রক্তকে প্রবাহিত হইতে না দিলে এখনকার সমস্যা ও সে সম্পর্কে জনসাধারণের ভাবনা, প্রত্যাশা, দাবি সম্পর্কে সম্যক অবহিতিই সম্ভব নয়। নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সাড়ে তিন বছর পরেও যে সিপিআইএম ঘুরিয়া দাঁড়াইতে পারিল না, তাহার মূল কারণ নিহিত রহিয়াছে অশীতিপর নেতৃত্বের মধ্যে। তরুণ প্রজন্মকে এই বৃদ্ধরা কিছুতেই জায়গা ছাড়িয়া দিতে আগ্রহী নন, বরং যে-কোনও উপায়ে, সম্ভব হইলে নির্লজ্জ গোষ্ঠীতন্ত্র অনুশীলন করিয়াও আপন কর্তৃত্ব কায়েম রাখিতে ব্যগ্র। কলিকাতা জেলা কমিটির নেতা নির্বাচন উপলক্ষেও তাহা স্পষ্ট হইল।
এই দলেই হরকিষেণ সিংহ সুরজিত্ যখন ভাল করিয়া দাঁড়াইতে পারেন না, অধিকাংশ সময় হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তখনও তাঁহাকে দলের সাধারণ সম্পাদকের শীর্ষ পদে একপ্রকার জোর করিয়া রাখা হইয়াছিল। তাহার আগেও নাম্বুদিরিপাদ সুস্থ থাকিতে-থাকিতে শীর্ষ দলীয় পদ হইতে ছাড় পান নাই। বৃদ্ধ নেতাদের সামনে রাখিয়া অবশ্য প্রায়শ অপেক্ষাকৃত তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষীরাই কলকাঠি নাড়িয়া থাকেন এবং নিজেদের উত্থানের পথটি মসৃণ করিতে তত্পর হন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদ হইতে অবসর লইয়া জ্যোতি বসু যখন দলীয় কাজকর্ম হইতেও অবসর লইতে উদ্গ্রীব, তখনও তাঁহাকে সামনে খাড়া করিয়া অনিল বিশ্বাসরা দল চালাইয়াছেন। এখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁহার অসুস্থতার দোহাই দিয়া দলীয় কাজকর্ম হইতে কিছুটা অবকাশ চাহিলেও তাঁহার ছাড় মিলিতেছে না। সুতরাং, মানিতেই হইবে, চুয়াত্তর অতি অল্প হইল।