বিশ্বাসঘাতক? ডেভিড গ্রিনগ্লাস (বাঁ দিকে) এবং ইথেল ও জুলিয়াস রোজেনবার্গ।
তাঁর মৃত্যুসংবাদটি গোপন ছিল সাড়ে তিন মাস। পরিবারের উদ্যোগে। সাংবাদিকদের গোয়েন্দাগিরিতে শেষমেশ জানাজানি। চুয়ান্ন বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে। নাম ভাঁড়িয়ে আমেরিকার এ-শহর থেকে ও-শহরে পলাতকের জীবন। শুধু এই সাধ নিয়ে বেঁচে থাকা যে, ‘মানুষ আমাকে ভুলে যাক।’ তা হয়নি। আড়ালে থেকেও মানুষের মনে দারুণ ভাবে হাজির ছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে ডজনখানেক বই। হবেই। তিনি যে দুনিয়া-কাঁপানো এক ভিলেন। ৯২ বছর বয়সে গোপন মৃত্যুও ‘বাঁচাতে’ পারল না তাঁকে। তিনি হলেন সংবাদ। কারণ, তার নাম ডেভিড গ্রিনগ্লাস।
তার ‘পাপ’? বলতে গেলে কিঞ্চিত্ ইতিহাস-আখ্যান জরুরি। ২৯ অগস্ট, ১৯৪৯। জাপান থেকে আলাস্কাগামী বি-টুয়েন্টিনাইন বিমানের গোয়েন্দা-যন্ত্রে ধরা পড়ল এক চিহ্ন। বাতাসে অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় কণা। ইঙ্গিত স্পষ্ট। অ্যাটম বোমা ফাটিয়েছেন সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্তালিন। খবরে আমেরিকা স্তম্ভিত। হতচকিত। কারণ আর কিছু নয়, রুশ প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পর্কে পশ্চিমের নিচু ধারণা। ১৯৪৭ সালেও আমেরিকায় অ্যাটম বোমা তৈরির দুই নায়ক জেনারেল লেসলি গ্রোভস এবং বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার বড় গলায় বলেছিলেন, পরমাণু বোমা বানানোর কৌশল রুশ বিজ্ঞানীরা ১৯৫৭ সালের আগে আয়ত্ত করতে পারবে না। তা হলে আট বছর আগে স্তালিনের হাতে ওই মারণাস্ত্র এল কোথা থেকে? গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আর এক তথ্য। তেজস্ক্রিয় কণা বিশ্লেষণ করে জানা গেল, স্তালিন যা ফাটিয়েছেন, তা জাপানের নাগাসাকিতে ফেলা বোমাটির হুবহু নকল। কী সাংঘাতিক!
দু’য়ে দু’য়ে চার হল কয়েকদিনের মধ্যে। যখন মার্কিন গোয়েন্দারা পাঠোদ্ধার করলেন ১৯৪৪ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে মক্সোয় পাঠানো রুশ গোয়েন্দাদের পাঠানো সাংকেতিক বার্তা। জানা গেল আমেরিকার বোমা-প্রকল্প ‘মানহাটান ডিস্ট্রিক্ট’-এ গোপনে কাজ করেছে স্তালিনের অনেক চর। ধরা পড়ল এক জন। ক্লস ফুক্স। জার্মান কমিউনিস্ট। অর্থলোভে নয়, স্রেফ কমিউনিজমের সেবায় বোমার নকশা পাচার করেছেন মস্কোয়।
জালে ধরা পড়ল আরও কয়েক জন। ১৬ জুন, ১৯৫০। গ্রেফতার হলেন ডেভিড গ্রিনগ্লাস। ২৮ বছর বয়েসি এক যুবক। নাহ্, তিনি ফুক্স নন। একদা কমিউনিজমের ভক্ত হিসেবে সোত্সাহে সোভিয়েত ইউনিয়নের চরবৃত্তি করলেও, স্তালিনের স্বমূর্তি ধারণ দেখে সে আদর্শে বীতশ্রদ্ধ। গ্রেফতার হওয়ার পর আপন কৃতকর্ম ফাঁস করলেন গ্রিনগ্লাস। দিশেহারা মার্কিন প্রশাসন তখন উদগ্রীব রুশ স্পাই-নেটওয়ার্ক ফাঁস করতে। আর কে-কে কী-কী তথ্য পাচার করেছে? গ্রিনগ্লাসের ওপর চাপ। চরম দণ্ড থেকে বাঁচতে হলে রাজসাক্ষী বনে যাও। বলে দাও স্যাঙাতদের নাম। নিজেদের প্রাণভয়ে এবং দুই শিশুপুত্রের ভবিষ্যত্ ভেবে কমিউনিজমে মোহভঙ্গ গ্রিনগ্লাস সিদ্ধান্ত নিলেন। বলে দিলেন কাদের প্ররোচনায় এবং মদতে চরবৃত্তিতে নেমেছিলেন তিনি। কমিউনিজমের স্বপ্নে বিভোর জামাইবাবু জুলিয়াস রোজেনবার্গ। এবং একই আদর্শে তদ্গতপ্রাণ দিদি ইথেল রোজেনবার্গ। অচিরে গ্রেফতার হলেন ওই দম্পতি।
বিচার শুরু হল টান-টান উত্তেজনার মধ্যে। পরিস্থিতি ঘোরালো। এশিয়ায় শুরু হয়েছে কোরিয়া-র যুদ্ধ। স্তালিনের মদতে উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করেছে দক্ষিণ কোরিয়াকে। আমেরিকার বিশ্বাস, কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন না ঠেকালে বাড়বে স্তালিনের লোভ। এর পর তাঁর বাহিনী চড়াও হবে এশিয়া কিংবা ইউরোপের নানা দেশে। সে সম্ভাবনা নির্মূল করতে মার্কিন সেনা যুদ্ধে নেমে পড়েছে দক্ষিণ কোরিয়াকে কমিউনিস্ট আক্রমণকারীর থাবা থেকে বাঁচাতে। যুদ্ধে মারা যাচ্ছে আমেরিকার যুবকেরা। সাধারণ মানুষের চোখে কমিউনিজম ঘৃণ্য এক মতাদর্শ। তারা মুণ্ডপাত করছে মার্কিন প্রশাসনেরও। আমেরিকায় বসে দিব্যি কাজ চালিয়েছে স্তালিনের চর-চক্র। সরকার এত দিন করছিলটা কী? ‘কিছু একটা’ করে নিজের মুখরক্ষা করতেই হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইসেনহাওয়ারকে।
সুযোগ এনে দিল রোজেনবার্গ দম্পতির বিচার। গোয়েন্দা দফতর এফ বি আই-এর প্রধান জন এডগার হুভার ওদের অপরাধকে আখ্যা দিলেন ‘ক্রাইম অফ দি সেঞ্চুরি’। শুনানির সময় কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের সম্পূর্ণ নির্দোষ ঘোষণা করলেন জুলিয়াস ও ইথেল। কমিউনিজমে ভক্তি? হ্যাঁ, তা আছে। গুপ্তচরবৃত্তি? না, তার সঙ্গে ছিটেফোঁটা সংস্রবও নেই তাঁদের। কমিউনিস্ট দুনিয়ার প্রচারের দামামা তুঙ্গে। মতাদর্শের কারণে দম্পতিকে বলির পাঁঠা করছে আমেরিকা।
সে সব নিন্দায় কাজ হল না কোনও। রাজসাক্ষী গ্রিনগ্লাস এবং তদন্তে গ্রেফতার অন্য গুপ্তচরদের সাক্ষ্যে জুলিয়াস এবং ইথেল চিহ্নিত হলেন আমেরিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। রাজসাক্ষী হয়ে তদন্তে সাহায্য করায় গ্রিনগ্লাসের সাজা কম। পনেরো বছর কারাবাস (পরে সেই মেয়াদ কমে দশ বছর)। আর রোজেনবার্গ দম্পতির সাজা চরম। মৃত্যুদণ্ড। নানা দিকে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ধিক্কার। ক্রুদ্ধ জা-পল সার্ত্র মন্তব্য করলেন, ‘এটা আইনের অছিলায় হত্যা। একটা গোটা জাতি গায়ে রক্ত মাখছে।’ দম্পতির প্রাণভিক্ষা করে আইসেনহাওয়ারের কাছে আবেদন জানালেন পোপ এবং পাবলো পিকাসো। সে সব নস্যাত্। ১৯ জুন, ১৯৫৩। রোজেনবার্গ দম্পতির ১৪তম বিবাহবার্ষিকী। ইলেকট্রিক চেয়ারে বসানো হল দু’জনকে। অবশ্য, ডেথ চেম্বারে ঢোকানোর আগেও প্রস্তাব— দোষ স্বীকার করে অন্য গুপ্তচরদের ধরিয়ে দিলে মকুব হবে প্রাণদণ্ড। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত।
ঠান্ডা যুদ্ধের জমানায় রোজেনবার্গ দম্পতি বিশ্বের দরবারে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছিলেন। হায়, ষাট বছর পরে সে ধারণা নির্মূল। একদা সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাঁর আত্মজীবনীতে কবুল করেন, ওই দম্পতি মূল্যবান তথ্য পাচার করেছিলেন তাঁর দেশে। তার পর একাধিক গবেষক প্রমাণ দিয়েছেন ওই দম্পতির চরবৃত্তির। আর গ্রিনগ্লাস? ‘ভিলেন’ তকমা তাঁকে ছাড়েনি। তাঁর পরিচয় ‘যে পাষণ্ড দিদি-জামাইবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী’।
কত-না সরলীকৃত এই ধারণা। এর মধ্যে নেই বাস্তবের উপাদান। নেই এই উপলব্ধি যে, আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলেও, ওই দিদি-জামাইবাবু আদতে গুপ্তচরই ছিলেন। নেই এই প্রত্যয় যে, আদর্শের প্রেরণা কিংবা তাতে মোহভঙ্গের যন্ত্রণা সমান শক্তিশালী।
‘ভিলেন’ আখ্যা না পেলেও ‘হিরো’ শিরোপা আর এক জন হারালেন সম্প্রতি। তিনি জোসেফ মিস্টার। চিকিত্সাবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয় নাম। ৯ বছর বয়সে তাকে পাগলা কুকুর কামড়ায়। জলাতঙ্কে মৃত্যু নিশ্চিত। সেই পরিস্থিতিতে ত্রাণকর্তা লুই পাস্তুর। যিনি সদ্য আবিষ্কার করেছেন ওই রোগের প্রতিষেধক। খুঁজেছেন এমন কাউকে, যার ওপর পরীক্ষা করবেন ওই প্রতিষেধকের ক্ষমতা। জোসেফের মা-বাবার সম্মতিক্রমে সেই পরীক্ষা। এবং তা সফল। না, শুধু এ কারণেই জোসেফ ‘হিরো’ বনে যাননি। তাঁর খ্যাতির মূলে আরও এক কাহিনি। ১৪ জুন, ১৯৪০। ফ্রান্স হিটলার বাহিনীর দখলে। ৬৪ বছর বয়সি জোসেফ তখন প্যারিসে পাস্তুর ইনস্টিটিউটের দাররক্ষী। সেখানে চড়াও নাত্সি সেনা। তাদের হুকুম, দেখিয়ে দাও পাস্তুরের সমাধি। একদা যার কৃপায় সাক্ষাত্ মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা, তাঁর কবর অপবিত্র করবে শত্রু-সেনা! হুকুম তামিল না-করে নাকি নিজের মাথায় পিস্তলের গুলি চালান জোসেফ।
হায়, ওই কাহিনি যে মিথ। জোসেফকে হিরো বানাতে পরবর্তী প্রজন্মের বানানো গল্প। বহু দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে কিছু গবেষক জেনেছেন, নিজের পিস্তলের গুলিতে নয়, বিষাক্ত গ্যাস শুঁকে আত্মহত্যা করেছিলেন মানুষটি। আত্মহত্যা বটে, তবে তা প্রয়াত প্রভুর মানরক্ষায় নয়, স্ত্রী-পুত্র হারানোর বেদনায়! কী রকম? আসলে, জার্মান সেনার গুলি থেকে স্ত্রী-পুত্রকে বাঁচাতে জোসেফ ওদের পাঠিয়েছিলেন প্যারিসের বাইরে। পাঠানোর পর আর ওদের খবর নেই। জোসেফের মনে হয় পথে শত্রুর গুলিতে মরেছে মা-ছেলে। হায়, পরামর্শের এই ফল। কে জানে, প্যারিসে থাকলে হয়তো বাঁচত ওরা। অনুশোচনায় তাই আত্মহত্যা। অদৃষ্টের কী পরিহাস! মিছেই অনুতপ্ত হয়েছিলেন জোসেফ। মারা যাননি তার স্ত্রী-পুত্র। অনেক দূর গিয়েও পালাতে না-পেরে ফিরেছিলেন প্যারিসে। ফিরেছিলেন জোসেফের আত্মহত্যায় কয়েক ঘণ্টা পরে।
এক জন ব্যক্তিগত কারণে রাজসাক্ষী। আর এক জন ব্যক্তিগত কারণে আত্মঘাতী। ডেভিড গ্রিনগ্লাস আর জোসেফ মিস্টারের আখ্যানের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম মিল আছে না?