যে জমিতে শিল্প হইল না, সেই জমিই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের নিকট আগামী বিধানসভা নির্বাচনের পাড়ানির কড়ি হইবে বলিয়া আশঙ্কা হইতেছে। দুই দিন ব্যাপী বাৎসরিক শিল্প পার্বণের ঘোষণা হইতে অনুমান, রাজ্যে ‘প্রোমোটারি’-র প্লাবন আসন্ন। তাহার জন্য বিপুল জমি প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী শিল্পের জন্য যে জমি জোগাড় করিতে অসম্মত হইয়াছেন, আবাসনের জন্যও সেই কৃষিজমিই চাই। অনুমান করা চলে, জমি মিলিবেও। রাজারহাটে যে পন্থায় মিলিয়াছিল, সেই পথেই। অবশ্য, শুধু এই রাজ্যে নহে, সর্বত্রই আবাসন গড়িতে কৃষিজমিই ব্যবহৃত হয়। ফারাক হইল, হরিয়ানার ন্যায় রাজ্যে কৃষিজমির চরিত্রবদল করিতে রাজ্য সরকারকে বিপুল টাকা দিতে হয়। গুড়গাঁওতে এক একর কৃষি জমি বাস্তুতে রূপান্তরিত করিতে সরকারকে দিতে হয় দুই কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা মাত্র। পশ্চিমবঙ্গ বাদে ভারতের আর কোনও প্রান্তে ল্যান্ড সিলিং নামক বিচিত্র আইন নাই। সিলিং অতিরিক্ত জমি রাখিতে এক নয়া পয়সাও ফি দেওয়ার প্রয়োজন নাই, শুধু ভূমি দফতরের অনুমতি প্রয়োজন। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে আবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহ করিবার প্রশ্নটি দুইটি ভিন্ন পথে সরকারের, অতএব শাসক দলের, ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকিল। এখানেই আশঙ্কা। এই রাজ্যে কত কাঞ্চনমূল্যে কোন ইচ্ছা জাগাইয়া তোলা যায়, রাজ্যবাসী বিলক্ষণ জানেন। বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বলগ্নে, বিশেষত যখন ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলি ঘোর বিপাকে, এই সরকারি সিদ্ধান্তটি ইঙ্গিতবাহী।
গোটা দেশেই জমির বাজার তেমন সুগঠিত নহে। পশ্চিমবঙ্গে বাজারটি নামমাত্র। অতএব, এই বাজারে, সাধারণ মানুষের স্বার্থেই, সরকারের উপস্থিতি অতি জরুরি। সরকার বাজারে কিছু নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ নিয়ম বাঁধিয়া দিবে, প্রত্যেককে সেই নিয়ম মানিতে বাধ্য করিবে, তাহাই কাম্য। এবং, সেই নিয়মের প্রাণকেন্দ্রে থাকিবে একটি নীতি— জমির মালিক এবং তাহার উপর নির্ভরশীল মানুষরা যেন কোনও ভাবেই বঞ্চিত না হন। মা-মাটি-মানুষের সরকার কার্যক্ষেত্রে বিপরীতগামী হইয়াছে। প্রতিটি আবাসন প্রকল্পকে পৃথক বিবেচনার ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তটিই অস্বচ্ছ। ল্যান্ড সিলিং-এর একুশে আইন যখন থাকিবেই, তখন তাহার ঊর্ধ্বে জমি রাখিবার জন্য সরকারি কোষাগারে বিপুল ফি জমা করিবার নীতি গ্রহণ বিধেয় ছিল। জমির চরিত্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অধিকতম মূল্য আদায় করা উচিত। অভিজ্ঞতা বলিতেছে, দুইটি ছাড়পত্র আদায়ের জন্যই বিনিয়োগকারীদের বহু টাকা খরচ করিতে হইবে। কিন্তু, সরকার আদায় করিলে যে টাকা সাধারণ মানুষের উপকারে লাগিত, বর্তমান ক্ষেত্রে তাহাই সম্ভবত শাসকদলের ভোটযজ্ঞে আহুতির কাজে লাগিবে।
অনেকের মনেই আশা ছিল, জমি লইয়া মুখ্যমন্ত্রীর জেহাদের মূল কারণ বুঝি জমিহারা মানুষের স্বার্থহানি ঠেকানো। মুখ্যমন্ত্রীই প্রমাণ করিয়া দিলেন, তাঁহার জেহাদ রাজনৈতিক প্রদর্শনমাত্র। নচেৎ, রাজ্যের নীতিনির্ধারণের সর্বোচ্চ আধিকারিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের কথা ভাবিতে পারিলেন না কেন? আবাসন গড়িবার জন্য জমি কিনিবার জন্য বিনিয়োগকারীরা জমির মালিক বা নির্ভরশীলদের যে টাকা মূল্যবাবদ দিবেন, মুখ্যমন্ত্রী কি তাহাকেই যথেষ্ট বোধ করেন? না করিলে, ল্যান্ড সিলিং ও জমি রূপান্তর বাবদ টাকা আদায় করিয়া তহবিল গড়িয়া সেই অর্থ যথাযথ লগ্নি করিয়া তাহার লাভ হইতে জমিহারাদের ভাতার ব্যবস্থা করাই বিধেয় ছিল। জমিহারাদের প্রতি ততখানি দরদ না থাকিলে সেই টাকায় রাজ্যের উন্নয়নেরও ব্যবস্থা করা যাইত। বাম আমলের শূন্য রাজকোষ বিষয়ে অভিযোগ বা ক্ষমাপ্রার্থনা অপেক্ষা রাজকোষ ভরিবার চেষ্টা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য নহে কি? তাহাতে অবশ্য দলীয় তহবিলের পুষ্টি যথেষ্ট হইবে না। মুখ্যমন্ত্রী কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেন, এই সিদ্ধান্ত তাহার ইঙ্গিত বহন করিতেছে।