একাদিক্রমে তৃতীয় বারের জন্য দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইতে উত্সুক মহিন্দা রাজাপক্ষে বৃহস্পতিবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার প্রতিদ্বন্দ্বী। মেয়াদ ফুরাইবার দুই বত্সর পূর্বেই এমন সিদ্ধান্ত কেন, তাহার জবাব সম্ভবত রহিয়াছে নির্বাচনী দ্বন্দ্বের মধ্যেই। প্রথমাবধি দেশের রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজাপক্ষে এই প্রথম সমবেত বিরোধী পক্ষের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাঁহার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাইয়াছেন তাঁহারই দলের দলত্যাগী নেতা এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য মৈত্রীপাল সিরিসেন। নির্বাচন ঘোষিত হইতে-না-হইতে সিরিসেন তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত জানাইয়া দেন। শুধু তাহাই নহে, রাজাপক্ষের দলের একের-পর-এক মন্ত্রী ও রাজনীতিক সিরিসেনের সমর্থনে সমবেত হইতে থাকেন। রাজাপক্ষে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। তবে এই অবসরে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লগ্নটি জমিয়া গিয়াছে। রাজাপক্ষে-বিরোধীরা নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করিতে নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন।
রাজাপক্ষের মূল গণভিত্তি সিংহলি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু তামিলদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রবক্তা। মূলত দক্ষিণ ও মধ্য শ্রীলঙ্কায় ছড়াইয়া থাকা এই জনসমষ্টি এলটিটিই-র গেরিলাদের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করার জন্য রাজাপক্ষের প্রতি যত্পরোনাস্তি কৃতজ্ঞ। তামিল ইলম-এর দুঃস্বপ্ন এখনও তাঁহাদের তাড়াইয়া ফেরে। কিন্তু কেবল গেরিলা নিধনের কৃতজ্ঞতায় ভর করিয়া রাজাপক্ষের পক্ষে আপন জনসমর্থন ও গণভিত্তি অনন্ত কাল জিয়াইয়া রাখা কঠিন। যুদ্ধকালীন উন্মাদনা, চাগাইয়া তোলা দেশপ্রেম, জনজাতীয় বিদ্বেষের বিষবাষ্প হাল্কা হইয়া গেলে সুশাসনের প্রশ্নটি ক্রমেই সামনে আসিয়া পড়ে। তখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিদ্যুত্-সড়ক-পানীয় জলের ন্যায় পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও বিকাশের সালতামামি সংগৃহীত হইতে থাকে। এই সব প্রশ্নে রাজাপক্ষে খুব শক্ত জমির উপর দাঁড়াইয়া নাই। উপরন্তু রহিয়াছে তাঁহার প্রতি দ্বীপভূমির তামিলদের স্বাভাবিক বিরূপতা। তত্সত্ত্বেও যখন জাফনায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়া রাজাপক্ষে নিজেকে ‘চেনা শয়তান’ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সিরিসেনকে ‘অচেনা পরি’ আখ্যা দিয়া, চেনা শয়তানকেই বাছিয়া লওয়ার জন্য তামিলদের জনাদেশপ্রার্থী হন, তখন বুঝা যায়, রাজাপক্ষে যথার্থই চাপের মধ্যে আছেন। আর এক সংখ্যালঘু, মুসলিম জনগোষ্ঠীও বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার উত্তরোত্তর উগ্র, আক্রমণাত্মক বিস্তার ও তাহার হাতে মুসলিমদের নিগ্রহের কারণে রাজাপক্ষের দিক হইতে মুখ ঘুরাইতে পারেন।
এই অবস্থায় দ্বীপরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হইবে কি না, সেই সংশয়টুকু প্রবল হইতেছে। যে-সকল নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নজরদারি সংস্থা সমগ্র ভোট-প্রক্রিয়ার উপর কড়া নজর রাখিতেছে, তাহাদের কাছে নিয়ত অসংখ্য কারচুপি, ভীতিপ্রদর্শনের অভিযোগ জমা পড়িতেছে। এমনকী সেনাবাহিনীও যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিতে পক্ষপাতমুক্ত থাকিতেছে, এমন নয়। জাফনায় রাজাপক্ষের সেনা এমন অন্তত ৪০০টি ব্যারিকেড গড়িয়া দিয়াছে, যেগুলি তামিল ভোটারদের নিরস্ত বা নিরুত্সাহিত করিতে ব্যবহৃত হইতে পারে। রাজাপক্ষে ও তাঁহার দল যদি যথার্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের মন জয় করিতে চাহেন, তবে এই নির্বাচনকে অবাধ এবং নিরপেক্ষ রাখিবার দায়িত্ব তাঁহাদেরই পালন করিতে হইবে।