সম্পাদকীয় ১

জঙ্গলতন্ত্র

একটির পর একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘জরুরি অবস্থা’ একটি প্রশ্ন তুলিতেছে। যে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ঠিক ভাবে চালানো যায় না, তাহার মধ্যে উদ্ভূত সংকটের মীমাংসার পথে যাইবার কোনও দিশাই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, সেই দেশে কী ভাবে বৃহত্তর প্রশাসন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় শাসন সুপরিচালিত হইবার আশা রাখে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৬ ০০:৩৪
Share:

একটির পর একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘জরুরি অবস্থা’ একটি প্রশ্ন তুলিতেছে। যে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ঠিক ভাবে চালানো যায় না, তাহার মধ্যে উদ্ভূত সংকটের মীমাংসার পথে যাইবার কোনও দিশাই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, সেই দেশে কী ভাবে বৃহত্তর প্রশাসন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় শাসন সুপরিচালিত হইবার আশা রাখে? প্রশাসন তো একটি গভীরতর বীক্ষা: সকলকে লইয়া কোনও তন্ত্র চালাইতে হইলে সেখানে সংকট আসা মোটেই অসম্ভব বা অপ্রত্যাশিত নহে, তাই জট আসিয়া উপস্থিত হইলে সর্ব পক্ষের সহিত আলোচনা-সাপেক্ষে জটটি ছাড়াইবার কাজটি স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসন-বীক্ষার অন্তর্গত। অথচ ইদানীং কালে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সংকট তৈরি হইলেই যেন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও সরকার সেই সংকট যে কোনও মূল্যে বহু গুণ বাড়াইয়া দিবার ব্রত লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে। কর্তৃপক্ষ বনাম ছাত্রসমাজ যুদ্ধের দামামা বাজিয়া উঠিতেছে। এফটিআইআই, জেএনইউ-এর পর হায়দরাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (এইচসিইউ) দেখাইয়া দিল প্রশাসনের নীতি: কিছুতেই মীমাংসার পথে যাইব না, যুদ্ধহুঙ্কারে ধরাতল কাঁপাইয়া দিব, ছাত্রছাত্রীদের যদৃচ্ছ মারধর ধরপাকড় করিব, বিনা বিচারে আটক রাখিব, দেখাইয়া দিব কত ধানে কত চাল। এইচসিইউ-তে যে ভাবে ক্যাম্পাসে জল-বিদ্যুৎ-খাদ্য সংযোগ বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল, অভুক্ত ছেলেমেয়েরা রান্না করিবার ব্যবস্থা করায় পুলিশ ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মীরা একত্র হইয়া তাহাদের বেদম পিটাইয়া কাবু করা হইল, তাহা জেএনইউ তাণ্ডবকেও বহু পিছনে ফেলিয়া দেয়। ফ্যাসিতন্ত্র এ বার হিংস্র জঙ্গলতন্ত্রে পরিণত হইতেছে।

Advertisement

জরুরি অবস্থা কথাটি আর কেবল আলংকারিক নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানাইয়াছে, এইচসিইউ ক্যাম্পাসে সত্যই পরিস্থিতি সহনসীমা ছাড়াইয়াছে। বিরোধী নেতারা রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ পর্যন্ত দাবি করিয়াছেন। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং তেলেঙ্গানা সরকার উভয়ের কাছেই রিপোর্ট তলব করা হইয়াছে। রোহিত ভেমুলার প্রসঙ্গে এই ছাত্র বিক্ষোভ ও পাল্টা সন্ত্রাস— যে উপাচার্যের উপর ভেমুলা ঘটনার দায় বর্তাইয়াছে, সেই পোডাইলকে পুনরায় বহাল করিবার সিদ্ধান্তই এই সংকটের মূলে। ভেমুলার আত্মঘাত ও উপাচার্যের দায় লইয়া আলোচনা এ ক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজন, কেননা মূল প্রশ্নটি বিষয়-নিরপেক্ষ। পশ্চিমবঙ্গ যতই পথ দেখাক, পুলিশি তাণ্ডব দিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট সমাধানের চেষ্টা অন্যায় ও নিষ্ফল। বাস্তবিক, তেলেঙ্গানা সরকার যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা লইয়াছে, দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির উপর সরকারি তর্জনীচালনার যুগেও তাহা বিশিষ্ট উল্লেখের অধিকারী। মুখ্যমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীকে কিছু উত্তর দিতে হইবে বই কী।

এই সকল প্রশ্নের তলায় অবশ্য আরও একটি সংশয় থাকিয়া যাইতেছে। এইচসিইউ-এর ঘটনা যে এত দ্রুত এমন চরমে পৌঁছাইল, তাহা কি এই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থানগত ও চরিত্রগত প্রান্তিকতার কারণে? অবস্থান ও জনসামাজিক অংশগ্রহণের বিচারে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রান্তিক বলিলে ভুল হইবে না। দলিত সমাজে উচ্চবর্ণের দাপট যে সহজেই নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হইতে পারে, তাহাও সহজে অনুমেয়। সুতরাং, কোনও দিক দিয়াই এইচসিইউ-কাণ্ডকে ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। একই সঙ্গে, জেএনইউ-এর মতো এই ঘটনা দেশব্যাপী প্রচারমাধ্যমে কেন ততখানি কলিকা পাইতেছে না, সেই প্রশ্নের উত্তরও প্রান্তিকতার রাজনীতিতেই নিহিত। বিভিন্ন বর্ণ ও বর্গের কর্তৃত্ববাদের একত্র সম্মিলনে এইচসিইউ আপাতত অনন্য ইতিহাসের দাবিদার।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement