স্বপ্নেই যদি বিনিয়োগ আনিবেন, তাহা হইলে মাত্র দুই লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার কোটি টাকা কেন? দুই দিনের বাণিজ্য সম্মেলন সারিয়া মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মোট প্রাপ্তি হিসাবে এই অঙ্কটিই ঘোষণা করিয়াছেন। হিসাবটি ভগ্নাংশে কষা হইল, নাকি ত্রৈরাশিকে, মুখ্যমন্ত্রী স্বভাবতই জানান নাই। অবশ্য বলিয়াছেন, চাহিলে তিনি তিন লক্ষ কোটি টাকাও বলিতে পারিতেন। তিনি ইচ্ছাময়ী, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু, বিনিয়োগ বস্তুটি নেহাতই বাস্তবের। তাহা হইলে আছে, না হইলে নাই। কোনও ইচ্ছা বা অনিচ্ছাতেই এই বাস্তব বদলাইবার নহে। সম্মেলন শেষে বিনিয়োগের যে ছবিটি পাওয়া যাইতেছে, তাহার খানিক অতীত, অবশিষ্টাংশ ভবিষ্যতের। সাগরে গভীর সমুদ্র বন্দরের বহু পুরাতন প্রকল্পটির নূতন নামকরণ হইয়াছে বটে, কিন্তু ‘ভোর হল দোর খোলো’ বলিলে খুকুমণি হয়তো বা উঠিতে পারে, বিনিয়োগ আসিবে না। কাটোয়ায় এনটিপিসি-র বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও বাম আমলের। অন্য দিকে, স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর বিনিয়োগ হিসাবে যে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ধরা হইয়াছে, তাহা সংস্থার পরিকল্পনার অংশমাত্র। সেই পরিকল্পনায় এখনও বোর্ডের অনুমোদন মেলে নাই। দেওচা-পাঁচামির কয়লাখনিও ভবিষ্যতের গর্ভে। পশ্চিমবঙ্গ কোন অন্ধকারে দাঁড়াইয়া আছে, তাহা বুঝিতে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট— ২০১২ সালে, বঙ্গেশ্বরীর শাসনের দ্বিপ্রহরে, এই রাজ্যে মাত্র ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়িত হইয়াছিল। এমন বাস্তবে দাঁড়াইয়া তিন লক্ষ কোটি টাকার স্বপ্ন দেখিতেও রীতিমত দুঃসাহস প্রয়োজন।
তবে, ভূত-ভবিষ্যৎ লইয়া টানাটানিই এই সম্মেলনের একমাত্র প্রাপ্তি নহে। ‘প্রোমোটিং’-এর খাতে ৭০,০০০ কোটি টাকা বাদ রাখিলে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া হিসাবের অধিকাংশ বিনিয়োগই প্রকৃত প্রস্তাবে কেন্দ্র হইতে প্রাপ্তি। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয়বরাদ্দ বাড়াইলে তাহাকেই রাজ্যে ‘বিনিয়োগের বন্যা’ বলিয়া দাবি করিবার মধ্যে দেউলিয়াপনা প্রকট। আর, কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা পাইতে দুই দিনের বাণিজ্য সম্মেলন প্রয়োজন হয় না। ভাইব্রান্ট গুজরাতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করিবার আর অবকাশ নাই, কিন্তু মধ্যপ্রদেশও যেটুকু পারে, পশ্চিমবঙ্গ তাহা পারে না। বিনিয়োগকারীরা আর এই রাজ্যের দিকে ফিরিয়া দেখেন না। সম্মেলনের প্রথম দিন অরুণ জেটলি প্রকারান্তরে এই কথাটিই বলিয়া গিয়াছিলেন। আরও সমস্যা, সব সরকারি প্রকল্পও যে শেষ অবধি রূপায়িত হইবে, তেমন ভরসাও নাই। কলিকাতা হইতে শিলিগুড়ি অবধি জাতীয় সড়কই যেমন। যেখানে জমির সমস্যায় রাস্তার সামান্য সম্প্রসারণ আটকাইয়া যায়, সেখানে এই সড়কের ভবিষ্যৎ কী? মুখ্যমন্ত্রীও সম্ভবত উত্তরটি জানেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তির ভাঁড়ার যে শূন্য, এই সম্মেলন তাহা দুই দিন ধরিয়া বলিয়াছে। এই শূন্যতা ভরিবার নহে। এই দফায় সম্মেলনে যে কতিপয় বিশিষ্ট শিল্পপতি উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও কেহ আর জমির প্রশ্ন তোলেন নাই। অমিত মিত্র ল্যান্ড ব্যাঙ্কের বাঁধা গৎ শুনাইয়াছেন। কেহ প্রতিবাদও করেন নাই। শিল্পমহল বুঝিয়া লইয়াছে, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্ন অর্থহীন। বঙ্গেশ্বরী এবং তাঁহার পারিষদবর্গ রাজনীতির সাধনা করিবেন। যাত্রা উৎসব যেমন হয়, ‘বেঙ্গল লিডস’-ও তেমনই একটি বাৎসরিক পার্বণমাত্র। যে প্রশ্নের সদুত্তর মিলিবে না, তেমন কোনও অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলিয়া কেহ আর উৎসবের মজা মাটি করিতে চাহেন নাই। তবে, যে ক্ষেত্রটি এই মৃত পশ্চিমবঙ্গেও সচল, এই বৎসরের বাণিজ্য পার্বণেও তাহার অগ্রগতির ইঙ্গিত পাওয়া গেল। অনুমান করা চলে, আবাসন নির্মাণ ক্ষেত্রে কিছু বিনিয়োগ হইবে। কিন্তু তাহাতে রাজ্যের প্রাপ্তি কতখানি, আর সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির আশঙ্কা কতখানি, সেই প্রশ্নটি থাকিয়াই যায়।