প্রবন্ধ

গরিব চাষির আয় বাড়ানোর সেরা রাস্তা

ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি যে পদ্ধতিতে চাষিদের টাকা ধার দেয়, তাতে বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদন কার্যত অসম্ভব। ফলে, কৃষকদের আয়ও বাড়ে না তেমন। এই সমস্যার মোকাবিলা করে বিকল্প পথের সন্ধান করলেন পাঁচ অর্থনীতিবিদ।কৃষির দারিদ্রমোচনের একটা প্রধান পথ, কৃষককে ক্রমে খাদ্যপণ্য থেকে বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বাণিজ্যিক ফসল মানে, যা উৎপাদন হয় শুধু বাজারে বিক্রি করার জন্যই নিজে ভোগ করার জন্য নয়। তৈলবীজ যেমন বাণিজ্যিক ফসল, তুলো, পাট ইত্যাদিও। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ফসল আলু।

Advertisement

সন্দীপ মিত্র

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

কৃষির দারিদ্রমোচনের একটা প্রধান পথ, কৃষককে ক্রমে খাদ্যপণ্য থেকে বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বাণিজ্যিক ফসল মানে, যা উৎপাদন হয় শুধু বাজারে বিক্রি করার জন্যই নিজে ভোগ করার জন্য নয়। তৈলবীজ যেমন বাণিজ্যিক ফসল, তুলো, পাট ইত্যাদিও। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ফসল আলু।

Advertisement

কিন্তু এই ফসল চাষ করার জন্য লগ্নির প্রয়োজন। বন্ধক দেওয়ার মতো সম্পদের অভাবে দরিদ্র কৃষকরা এই লগ্নির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পান না। তা ছাড়াও, কোন কৃষক সত্যিই এই জাতীয় বাণিজ্যিক ফসল চাষের জন্য তৈরি, সেটা বোঝাও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সংস্থাগুলির পক্ষে মুশকিল। বকেয়া ঋণ পুনরুদ্ধারও সমস্যার। বকেয়া ঋণ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণগুলি বেশি সফল। ক্ষুদ্র ঋণই হোক অথবা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে দেওয়া বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ঋণ, দেখা গিয়েছে, স্থানীয় সম্পর্ক ব্যবহার করে দরিদ্র অথচ উপযুক্ত কৃষককে ঋণ দেওয়া গিয়েছে, এবং তাঁরাও সময়ে টাকা শোষ করেছেন।

কিন্তু, এই গোত্রের ক্ষুদ্র ঋণগুলি বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনে উৎসাহ দিতে ব্যর্থ। আমাদের অনুমান, ক্ষুদ্র ঋণ পরিশোধের জন্য যে ভাবে সময়সীমা ধার্য করা হয়, সেটা এই ব্যর্থতার একটা বড় কারণ। প্রতি সপ্তাহে বা দু’সপ্তাহে, বড় জোর প্রতি মাসে টাকা ফেরত দেওয়ার তারিখ থাকে। বাণিজ্যিক ফসলের ক্ষেত্রে লগ্নি করার পর অন্তত চার মাস লাগে টাকা তুলতে। এই বিনিয়োগের ঝুঁকিও বেশি। দ্রুত ঋণ পরিশোধের শর্ত আরোপ মানেই বাণিজ্যিক ফসল চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহ করা।

Advertisement

অর্থাৎ, কৃষকদের ঋণ পাওয়ার যে রাস্তাগুলো এখন খোলা রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফসল চাষ বাড়িয়ে কৃষকের আয়বৃদ্ধির উপায় কার্যত নেই। অতএব, একটি নতুন, ভিন্ন পথ প্রয়োজন। আমরা পাঁচ অর্থনীতিবিদ (অন্য চার জন হলেন পুষ্কর মৈত্র, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, অ্যালবার্টো মোট্টা ও সুজাতা ভিসারিয়া) তেমনই একটি পথ খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমরা একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ৪৮টি গ্রামে একটি পরীক্ষা চালাই— অর্থনীতির পরিভাষায় যে গোত্রের সমীক্ষাগুলিকে ‘র্যান্ডামাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল’ বলা হয়ে থাকে। ২৪ গ্রামে আমরা আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে ঋণ দিই। অন্য ২৪টিতে আমাদের সঙ্গী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে ঋণ দেয়। ঋণ দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রচলিত বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য আলু চাষের জন্য। দুটি ক্ষেত্রেই ঋণের সুদের হার ১৮ শতাংশ নির্ধারিত হয়, যা এই গ্রামগুলিতে প্রচলিত সুদের হারের তুলনায় প্রায় ছয় শতাংশ কম। যেহেতু গ্রামগুলিকে কোনও রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই বাছা হয়েছিল, অতএব, সমীক্ষার শেষে আমাদের ২৪টি এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ২৪টি গ্রামের কৃষকদের আয়বৃদ্ধির যা ফারাক, সেটা শুধুমাত্র দুটি পদ্ধতির ফলেরই ফারাক। কোন পদ্ধতিটি কৃষি-আয় বাড়াতে বেশি কার্যকর, তা বোঝার জন্য ফারাকটির দিকে নজর রাখলেই চলবে। উল্লেখ করা যাক, যাঁদের সম্মিলিত জমির মাপ দেড় একরের কম, শুধুমাত্র তাঁরাই ঋণ পেয়েছেন এই প্রকল্পে।

যে চব্বিশটি গ্রামে প্রথাগত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা কৃষকদের ধার দিল, সেখানে শুধু সুদের হারটুকু ছাড়া আর সবই সংস্থার নিয়ম মেনে চলেছে। তবে, ঋণ পাওয়ার জন্য কোনও বন্ধক রাখতে হয়নি। কাকে ঋণ দেওয়া হবে, আর কাকে হবে না, সেটা সংস্থাই স্থির করেছে। অন্য দিকে, আমরা যে নতুন পদ্ধতিটি পরীক্ষা করে দেখছিলাম, সেটা এই রকম: প্রতিটি গ্রামে কয়েক জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে আমরা এজেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছিলাম। তাঁরা কেউ মুদিখানা চালান, আবার কেউ কৃষিপণ্যের মধ্যস্বত্বভোগী। গ্রামের সব ব্যবসায়ীর মধ্যে থেকে এই এজেন্টদের লটারির মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের ওপর ছিল কৃষক বাছাইয়ের ভার। এমন প্রান্তিক কৃষক, এই এজেন্টরা যাঁকে উৎপাদনশীল মনে করেন, এবং বিশ্বাস করেন যে তাঁরা ঋণের টাকা যথাসময়ে ফেরত দেবেন। এজেন্টদের প্রস্তাবিত নাম থেকে আবার লটারির মাধ্যমে বেছে নেওয়া হল কিছু কৃষককে। আমাদের পরীক্ষায় যে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা যুক্ত ছিল, তারা আর কোনও রকম খোঁজখবর না করে ঋণ দিল এই লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকদের। ঋণ পাওয়ার চার মাস পর, ফসল উঠলে তবেই শোধ করতে হবে ঋণের টাকা। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ শোধ করলে পরের বার আরও বেশি ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হল। প্রতিকূল আবহাওয়া বা বাজারের মন্দার জন্য ফসলের প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা কাটাতে ব্যবস্থা হল ফসল-বিমারও। আর, এজেন্টদের জন্য শর্ত: তাঁদের তালিকা থেকে নির্বাচিত কৃষকদের অর্ধেকের কম যদি ঋণ শোধ করেন, বা ঋণশোধের পরিমাণ যদি মোট ঋণের অর্ধেকের কম হয়, তা হলে পরের বার এজেন্ট হওয়ার সুযোগ থাকবে না তাঁদের। যথাসময়ে ঋণ শোধ হলে এজেন্টরা তার থেকে কমিশন পাবেন। আমাদের পদ্ধতিতে মধ্যস্থতাকারীরা সকলেই ট্রেডার বা ব্যবসায়ী, তাই পদ্ধতিটির নাম ট্রেডার-এজেন্ট ইন্টারমিডিয়েটেড লোনস বা সংক্ষেপে ‘ট্রেল’।

দু’গোত্রের গ্রামে দু’ধরনের ঋণ দেওয়ার পর ফসল উঠে যখন তা বিক্রি হয়ে চাষির হাতে টাকা এল, এবং ঋণ পরিশোধ হল, তখন তাদের ফারাক হিসেব কষে দেখা হল। দেখা গেল, যে গ্রামগুলোয় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা টাকা ধার দিয়েছিল, তাদের তুলনায় ট্রেল গ্রামগুলোতে কৃষকের লাভের পরিমাণ ১৭ শতাংশ বেশি। বাড়ির আয়বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার গ্রামের তুলনায় ট্রেল গ্রাম ১৮ শতাংশ এগিয়ে আছে। ফসল উৎপাদনের পরিমাণও বেশি ট্রেল গ্রামে। অন্য দিকে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে ট্রেল গ্রামগুলোই।

ট্রেল-এ প্রতি সাত বা পনেরো দিনে টাকা শোধ করার বালাই নেই। নিয়মিত গোষ্ঠী-বৈঠকের ঝামেলাও নেই। ফলে, কৃষক চাষের দিকেই পুরো মন দিতে পারেন। কিন্তু, ট্রেল-এর সাফল্যের এটা বড় জোর আংশিক কারণ। বড় কারণ, পদ্ধতিটি এমন একটা সুবিধা পেয়েছিল, যেটা প্রথাগত ব্যাঙ্ক ঋণ বা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার পক্ষে, তাদের কাঠামোগত কারণেই, অসম্ভব। ট্রেল-এ আমরা গ্রামীণ সমাজের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সম্পর্ককে ব্যবহার করেছিলাম।

যাঁরা এজেন্ট হলেন, তাঁরা এমনিতেই গ্রামীণ সমাজে খানিক প্রতিপত্তিসম্পন্ন মানুষ। এই এজেন্সি তাঁদের আরও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সুযোগ এনে দিল, কারণ কোন কৃষক ঋণ পাবেন, সেটা প্রাথমিক ভাবে তাঁদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। অতএব, তাঁরা চেষ্টা করেছেন এমন কৃষককেই বাছার, যাঁরা উৎপাদনশীল, ফলে যাঁদের ঋণশোধের সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি। এজেন্টরা গ্রামেরই মানুষ, ফলে কৃষকদের দক্ষতার বিষয়ে তাঁদের ধারণা থাকা স্বাভাবিক। কোনও ব্যাঙ্ক বা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার পক্ষে প্রতিটি কৃষকের ব্যক্তিগত দক্ষতা যাচাই করার এমন কোনও কুশলী ব্যবস্থা নেই। আবার যাঁরা ঋণ পেয়েছেন, এটা এক দিকে তাঁদের কাছে বড় সুযোগ, কারণ প্রথাগত ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের সমস্যা থাকেই। তাঁরা অনেক কম সুদের হারে এমন ঋণ পেয়েছেন, যা শোধ করলে পরের বার ৩৩ শতাংশ বেশি ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে। আবার প্রাপক বাছাই এবং ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়াগুলি যেহেতু প্রকাশ্যে হয়েছে, ফলে ঋণ নিয়ে চাষ না করার মধ্যে সামাজিক সম্মানহানির ঝুঁকি ছিল। প্রাপকরা তাই নিজের সেরাটা দিয়ে চাষ করেছেন।

আমরা মানুষকে বিশ্বাস করার পথ খুঁজে পেয়েছি। যথেষ্ট তথ্যসমর্থিত বিশ্বাস, ঠিকঠাক আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে তৈরি। সামাজিক পরিসরে এই বিশ্বাসের দাম অনেক। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গ্রামে এজেন্টের মাধ্যমে ঋণ বণ্টনের কথা বলেছে। ট্রেল-এর পথটি সে ক্ষেত্রে কার্যকর হবে বলেই বিশ্বাস।

কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement