সম্পাদকীয় ১

কমলবনে

আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিয়মিত বিশ্বরূপ পরিদর্শন করিবার অভ্যাস না থাকিলে যাদবপুরের উপাচার্যের পদত্যাগের সংবাদে নিজের ‘কৃতিত্ব’ অস্বীকার করিবার বিনয় আয়ত্ত করা মুশকিল। মুখ্যমন্ত্রী কাজটি সহজাত পারদর্শিতায় করিয়াছেন। তাঁহার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, বিশেষত মুখ্যমন্ত্রিত্বের পর্বে, তাঁহার অহংসর্বস্বতার বিচিত্র সব দৃষ্টান্ত মিলিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিয়মিত বিশ্বরূপ পরিদর্শন করিবার অভ্যাস না থাকিলে যাদবপুরের উপাচার্যের পদত্যাগের সংবাদে নিজের ‘কৃতিত্ব’ অস্বীকার করিবার বিনয় আয়ত্ত করা মুশকিল। মুখ্যমন্ত্রী কাজটি সহজাত পারদর্শিতায় করিয়াছেন। তাঁহার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, বিশেষত মুখ্যমন্ত্রিত্বের পর্বে, তাঁহার অহংসর্বস্বতার বিচিত্র সব দৃষ্টান্ত মিলিয়াছে। সোমবার সন্ধ্যার যাদবপুর যাহা প্রত্যক্ষ করিল, এক অর্থে তাহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের সারাত্‌সার। এক দিকে অহংসর্বস্বতা, অন্য দিকে বুদ্ধিহীনতা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহার অধিকারের সীমার বাহিরে। সেই সীমাটি তিনি কখনও মানেন নাই, ইহাই তাঁহার বিরুদ্ধে প্রধানতম অভিযোগ ছিল। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তাঁহার ভরসায় অনশনে বসিয়াছিলেন, বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। তাঁহাদের চাপের নিকট মুখ্যমন্ত্রীকে নতিস্বীকার করিতে হইল। তবু, তাহাকেই তিনি ‘নিজের জয়’ ভাবিলেন, এবং জয়ের কৃতিত্ব ছাত্রদের দিতে চাহিলেন। যে ভাবে বড়রা শিশুদের মন রাখিয়া থাকেন, সেই ভঙ্গিতে। নিজের সমূহ পরাজয়কেও নিজেরই কৃতিত্ব বলিয়া ভাবা এবং নিজের প্রতিস্পর্ধীকেও নিজের অংশ জ্ঞান করা সম্ভবত মেগালোম্যানিয়া বা অহংসর্বস্বতার চূড়ান্ত ধাপ।

Advertisement

যাদবপুর-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতির আদি-অন্ত জুড়িয়া এই অহংসর্বস্বতাই আছে। সব প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার করিবার বামপন্থী তাড়নায় তিনি যাদবপুরেও ‘নিজের লোক’ বসাইয়াছিলেন। সেই স্ব-জনকে সরাইতে তিনিই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন। কোনও বিধির তোয়াক্কা না করিয়া, প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতির ধার না ধারিয়া, এমনকী নিজের পদমর্যাদার কথাটুকুও না ভাবিয়া তিনিই উপাচার্যের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করিলেন। কোনও স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এতখানি অবিবেচক হওয়া মুশকিল। কিন্তু, বঙ্গেশ্বরীর মানসজগতে তিনিই সব। কোনও একটি প্রতিষ্ঠান তাঁহার আওতার বাহিরে থাকিতে পারে, কোনও একটি পরিসরে তিনিই সর্বেসর্বা না-ও হইতে পারেন, এই কথাগুলি বিশ্বাস করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। এবং, তিনি মনেপ্রাণে জানেন, একমাত্র তাঁহার পক্ষেই সব ‘ঠিক করিয়া দেওয়া’ সম্ভব। গঙ্গাসাগরের তাঁবু পর্যবেক্ষণ আর যাদবপুরে উপাচার্য সমস্যার সমাধানে তিনি বিশেষ ফারাক দেখেন না। ফলে, তাঁহার বিবেচনায় যাহা কুলাইয়াছে, তিনি করিয়াছেন। পুতুল নাচের আসরে যে খেলোয়াড়ের প্রকাশ্যে না আসাই দস্তুর, এই কথাটি মুখ্যমন্ত্রী বুঝিতে পারেন নাই। বামপন্থীর নিকট তিনি নিয়ন্ত্রণের বাসনাটি শিখিয়াছেন, কিন্তু সেই তাড়নাকে প্রকাশ্যে না আনিবার মন্ত্রটি আয়ত্ত করিতে পারেন নাই।

এই বিবেচনার অভাবকে প্রকট করিয়া তুলিল মুখ্যমন্ত্রীর ভয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহার উপস্থিতি বলিয়া দিতেছিল, তিনি ভয় পাইয়াছেন। তাঁহার নিয়ন্ত্রণেচ্ছা প্রতিরোধের এমন প্রাচীরে ধাক্কা খাইবে, তিনি বুঝিতে পারেন নাই। সেই ভয়ই তাঁহাকে বিনা নিমন্ত্রণে, বিনা ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। খেলা বাঁচাইবার মরিয়া চেষ্টায় তিনি বেমক্কা ব্যাট চালাইয়াছেন। তাহাতে অবশ্য লোপ্পা ক্যাচ উঠিল। অনুমান, ঘরে-বাইরে জেরবার মুখ্যমন্ত্রী আর কিছু বুঝিতে পারিতেছেন না। সমস্যা তিনি নিজেই ডাকিয়াছেন। অহংসর্বস্বতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতার অব্যর্থ মিশেলে। যাদবপুর মোক্ষম উদাহরণ। প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের নিয়মে চলিতে দিলে যে সমস্যার আঁচ কালীঘাট অবধি পৌঁছাইত না, তিনি স্বেচ্ছায় তাহাকে ঘাড়ে লইয়াছিলেন। ‘স্বখাতসলিল’ শব্দটির অর্থ তিনি ক্রমে শিখিতেছেন। রাজ্যের বর্তমান হাল বলিতেছে, শিক্ষা এখনও শেষ হয় নাই।

Advertisement

আগামী কাল: আত্মঘাতী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement