কমিউনিস্টদের সেই টানাপড়েন আজও গেল না

শুধু ব্যবস্থা পরিবর্তনের সাবেক স্লোগান দিয়ে লাভ নেই। বদলাতে হবে ভারতীয় কমিউনিস্ট মূল্যবোধের কিছু জং ধরা ধ্যানধারণা। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।১৯২৫ সালে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছিল। সেই একই বছর জন্ম হয়েছিল আরএসএসের। কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয় ১৯৬৪ সালে। এর পর নকশালবাদী ও মাওবাদী আন্দোলনও আবার সিপিএমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। জনসঙ্ঘের জন্ম হয়েছে ১৯৫১ সালে। অন্য দিকে আরএসএসের পাশাপাশি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। বিজেপির জন্ম ১৯৮০-তে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ২৮২টি আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন। যে কমিউনিস্ট পার্টি একদা ভারতের রাজনীতিতে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল, সেই কমিউনিস্ট পার্টির আজ কেন এমন হাল হল, সেটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৪ ০০:০৬
Share:

১৯২৫ সালে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছিল। সেই একই বছর জন্ম হয়েছিল আরএসএসের। কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয় ১৯৬৪ সালে। এর পর নকশালবাদী ও মাওবাদী আন্দোলনও আবার সিপিএমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। জনসঙ্ঘের জন্ম হয়েছে ১৯৫১ সালে। অন্য দিকে আরএসএসের পাশাপাশি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। বিজেপির জন্ম ১৯৮০-তে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ২৮২টি আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন। যে কমিউনিস্ট পার্টি একদা ভারতের রাজনীতিতে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল, সেই কমিউনিস্ট পার্টির আজ কেন এমন হাল হল, সেটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে। যে ভাবে ভারতীয়ত্বকে সঙ্ঘ পরিবার তাদের রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে, সেটা সঠিক ভারতীয়ত্ব নয়, এমন অভিযোগ অনেকে করে থাকেন। সেই মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চয়ই আছে।

Advertisement

পি সি জোশী

স্তালিন

Advertisement

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হয় যে ভারতীয় কমিউনিস্টরা যে ভাবে যাত্রাপথ শুরু করেছিলেন, সেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাজাত্যবোধ ছিল। কিন্তু মূলত মেরঠ ষড়যন্ত্র মামলার পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি অনেকটাই চলে যায় কমিনটার্নের নিয়ন্ত্রণে। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, স্তালিনের নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করা এবং হালে আর্থিক উদারবাদ ও তার বিশ্বজনীন সামাজিক প্রভাবকে দলীয় কর্মসূচির সঙ্গে খাপ খাইয়ে না নেওয়া, এগুলোও হয়তো আজকের কমিউনিস্ট পার্টির মুখ থুবড়ে পড়ার একটা অন্যতম কারণ।

কয়েক দিন আগে একটি বই পড়লাম। বইটির নাম ‘পিপল্স ওয়ারিয়র-ওয়ার্ডস অ্যান্ড ওয়ার্ল্ডস অফ পি সি জোশী’। বইটি সম্পাদনা করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গার্গী চক্রবর্তী। এই বইটিতে শুধু পি সি জোশীর পুরনো লেখাই নয়, এই প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা সম্পর্কে ঐতিহাসিক সুমিত সরকার, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুদীপ্ত কবিরাজ প্রমুখের অসাধারণ নিবন্ধ রয়েছে। পূরণচাঁদ জোশী (পি সি জোশী) মাত্র ২৮ বছর বয়সে, ১৯৩৬ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। অথচ এই মানুষটাই ১৯৪৮ সালে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে দল থেকে বিতাড়িত হন। পি সি জোশী সেই সময়ের পটভূমিতে সোভিয়েত সমর্থক ছিলেন। তিনি কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনকে প্রসারতি করার জন্য ভারতীয় সংস্কৃতিকে যে মূলধন করতে হবে সেটাও চেয়েছিলেন ভীষণ ভাবে। আইপিটিএ এবং লোকসংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে নিয়ে আসা, এ সবের পিছনে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কিন্তু এই যে কথায় কথায় ভারতের সব সমস্যা স্তালিন মস্কোতে বসে সমাধান করে দেবেন, এই মনোভাবে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি।

ঐতিহাসিক সুমিত সরকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, এক বার জোশী তাঁকে বলেছিলেন, “দেখো সুমিত, এটা খুব অবাক লাগে যে আমার তিরিশ বছর বয়সে অনেক বেশি প্রভাবশালী ছিলাম। এখন আমার ষাট বছর বয়সে আমার কোনও প্রভাব নেই।” সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রথমে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ লাইন নিয়েছিলেন। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তাতে মাথা নেড়ে স্বাগত জানিয়েছিল। আবার কিছু দিনের মধ্যেই তারা মত বদলে দেশভাগকে মেনে নেয়। তখন আবার কমিউনিস্ট পার্টি তাতে সাড়া দেয়। পি সি জোশী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলে তিনিই বিতর্কের মুখে পড়েন। তখন কমিউনিস্ট পার্টিতে সোভিয়েতকে মানাটাই ছিল দস্তুর। আবার, ১৯৬৭-তে সোভিয়েত পার্টি যখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে বলে যে তোমরা কংগ্রেস বিরোধী শক্তি, এমনকী জনসঙ্ঘকেও সমর্থন করতে পারো, তখন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বামেরা বেশ সমস্যায় পড়েছিল এবং নেহরু-উত্তর কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কী সম্পর্ক হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তখন জনসঙ্ঘের ভূমিকাকে লঘু করে দেখেছিলেন অনেক কমিউনিস্ট নেতা। পি সি জোশী কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপদ নিয়ে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন।

আজ ২০১৪ সালে এসেও কমিউনিস্টদের সেই টানাপোড়েন কিন্তু থেকে গিয়েছে। পি সি জোশী প্রথম থেকেই কংগ্রেসের মতো শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। তার থেকেও বড় কথা, সশস্ত্র বিপ্লবের পথ পরিহার করে পি সি জোশী দলকে সংসদীয় পথে আনতে চেয়েছিলেন। সুদীপ্ত কবিরাজ বলেছেন, সেই কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় পথে গেল, কিন্তু তার তাত্ত্বিক পটভূমি তৈরি করার কৃতিত্ব পি সি জোশী পেলেন না। তত দিনে তিনি দল থেকে বিতাড়িত।

মার্কসবাদী কিছু গবেষক এটাও বলছেন যে, ভারতের কমিউনিস্টরা শুরুতেই যে সোভিয়েত মুখাপেক্ষী ছিলেন তা নয়। কিন্তু মেরঠ ষড়যন্ত্র মামলার পর যখন বহু শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতাকে জেলে যেতে হল, তখন কমিনটার্নের নিয়ন্ত্রণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপর অনেক বেড়ে গেল। তখন সরাসরি স্তালিন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ফলে বলা যায় ১৯৩১ সালের পর থেকে দলের এই প্রবণতাটা বাড়ল। সুমিত সরকারও তাঁর লেখায় বলেছেন, অনেক অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়েও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা স্তালিনের কাছে চলে যেতেন এবং স্তালিন সেগুলোর সমাধান করতেন। এই সোভিয়েত নির্ভরশীলতা থেকে অবশ্য পরবর্তী কালে গ্রামসি অনুপ্রাণিত ইতালির কমিউনিস্ট নেতারা নিজেদের সরিয়ে এনেছিলেন। চিন ও যুগোশ্লাভিয়াও করেছিল। পরবর্তী কালে ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ ভারতীয় সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু এমন একটা বহুত্ববাদী দেশে এত জাতপাতের জটিলতায় কমিউনিস্ট পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রণকৌশল নিয়ে ভাবনাচিন্তা কিন্তু হয়েছে অনেক পরে।

আজ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নেতা কয়েক দিন আগেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আর্থিক উদারবাদ সমাজের যে সব পরিবর্তন ডেকে আনছে, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। নতুন প্রজন্ম মনে করছে, শিল্পায়ন, উৎপাদন, বৃদ্ধি— এ সবের সুযোগ নিতে হবে। তাতে কর্মসংস্থান হবে।’ কাজেই এই বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে দলকে সময়োপযোগী করার কথা তিনি নিজেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। বুদ্ধদেব বললেও দলের মধ্যে এই নতুন ভাবনার হাওয়া দেখছি কই? শুধু ব্যবস্থা পরিবর্তনের সাবেকি স্লোগান দিয়ে লাভ নেই। বদলাতে হবে ভারতীয় কমিউনিস্ট মূল্যবোধের কিছু জং ধরা ধ্যানধারণা।

দোহাই, যাঁরা দলের এই ভাবনার সংস্কার আর মার্কসীয় মুক্ত চিন্তার কথা বলছেন, তাঁদের শ্রেণিশত্রু বলে চিহ্নিত করবেন না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement