বছরখানেক আগে এক আলোচনাসভায় গিয়েছিলাম। মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা। স্বভাবতই পুলিশ নিয়ে অনেক কথা হল। ডায়েরি নিতে না চাওয়া থেকে শুরু করে থানায় দুর্ব্যবহার, অত্যাচার, দুর্নীতি, রাজনৈতিক চাপে শিষ্টের দমন এবং দুষ্টের পালন নানা দৃষ্টান্ত, নানা অভিযোগ। কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পুলিশের কর্তা এবং কর্মীদের সংবেদনশীল করে তোলার জন্য কি নাগরিক সমাজ চেষ্টা করতে পারে না?’ সঙ্গে সঙ্গে এক প্রবীণ সমাজকর্মী তীব্র স্বরে বললেন, ‘এ-সব কোনও কাজের কথাই নয়, পুলিশকে সংবেদনশীল হতে হবে না, পুলিশ নিয়ম মেনে কাজ করুক, ব্যস, তা হলেই হবে।’ তার পর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার থেকে দৃষ্টান্ত দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে বললেন, কেন তিনি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, কেন ‘সংবেদনশীল’ বা ‘মানবিক’ পুলিশের ধারণাটিকে সোনার পাথরবাটি বলেই মনে করেন তিনি। মানবাধিকারের প্রশ্নে পুলিশের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরা অনেকেই নানা নজির তুলে ওই মানুষটির কথা সমর্থন করেছিলেন। ভুল ভেঙেছিল। উপলব্ধি করেছিলাম, বাস্তব অভিজ্ঞতা কেন এতখানি মূল্যবান।
সেই উপলব্ধি নতুন করে একটা হতাশারও জন্ম দিয়েছিল। পুলিশ প্রশাসন যাঁরা চালান, তাঁরা অন্তত কিছুটা সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারেন, এই ভরসাটুকু যদি সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হয়, তা হলে কি তাঁদের নিয়ম মেনে চলার কোনও ভরসাও অবশিষ্ট থাকে? একটা নিজস্ব মানবিক বোধ না থাকলে কে তাঁদের নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করবে? ঠিকই, পুলিশ প্রশাসনের অন্যায় দমনে আদালত একটা ভূমিকা নিতে পারে, অনেক সময় নেয়ও, তাতে কখনও কখনও কাজও হয়। সচেতন, সংগঠিত নাগরিক সমাজের শ্যেনদৃষ্টিও নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ নিষ্ফল নয়। কিন্তু এ ভাবে ইতস্তত কিছু উপশম হতে পারে, ব্যাধি সারানো কি সম্ভব? অভিজ্ঞতা সে ভরসা দেয় না।
সুমন মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কাহিনি সেই উপলব্ধিকে ফিরিয়ে আনল। এই কাহিনির আইনি বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে বিস্তর হয়েছে। এর পশ্চাদ্বর্তী রাজনীতির ছায়াটি এত ঘনঘোর যে, তা নিয়েও নতুন করে কিছু বলার নেই। এমন আরও বহু কাহিনি হয়তো রচিত হবে মনে করার কোনও কারণ নেই যে, অম্বিকেশ মহাপাত্র শিলাদিত্য চৌধুরিদের তালিকায় সুমন মুখোপাধ্যায়ের নামই শেষ সংযোজন। সম্পূর্ণ অহেতুক এবং অজ্ঞাত, অনিশ্চিত, রহস্যময় আতঙ্ক সৃষ্টি করে ক্ষমতার তান্ত্রিকরা কী ভাবে ব্যক্তি এবং সমাজকে অনুগত রাখতে চান, তা জানার জন্য কাফকা পড়ার দরকার হয় না, এ তন্ত্র আমরা আগেও দেখেছি, এখনও দেখছি, হয়তো আর একটু নিরাবরণ, আর একটু নির্লজ্জ আকারে। যত দিন যাবে, তান্ত্রিকদের সমস্যা ও উদ্বেগ যত বাড়বে, ততই হয়তো আড়াল আরও কমবে, বেসরকারি বিনিয়োগে না হোক, সরকারি আতঙ্কের দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়তো বা গুজরাতের সমকক্ষ হয়ে উঠবে।
কিন্তু সে-সব থাকুক। আমি ভাবছিলাম নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা। ব্যক্তির কথা। পুলিশ প্রশাসনের যে কর্তাব্যক্তিরা তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদের এই প্রক্রিয়া চালিয়েছেন, তাঁরা উর্দি পরেন। কিন্তু তাঁরা তো উর্দি নন, লাঠি বা বন্দুকও নন, প্রত্যেকে এক এক জন ব্যক্তিমানুষ। এক জন সহনাগরিকের সঙ্গে, তিনি ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ হোন বা না হোন, যে কোনও মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করছেন, সেটা তো শেষ অবধি ওই কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তি হিসেবেই চিনিয়ে দেয়। আর তাই, কোনও কিছুতেই এখন আর বিস্মিত হতে নেই জেনেও বিস্মিত হয়ে ভাবতেই হয় স্রেফ ‘খোঁজখবর’ নেওয়ার জন্য একটা মানুষকে এই ভাবে হয়রান করা যায়? এবং তার পরে বড় মুখ করে ‘যা করেছি, আইন মেনে করেছি’ বলে প্রবল দাপটে উঠে চলে যাওয়া যায়? আইনের কথা আইনবিশারদরা বলবেন, কাণ্ডজ্ঞানের প্রশ্ন একটাই: আইন যা-ই বলুক, কাউকে এ ভাবে হেনস্থা করা হবে কেন?
আইন রাষ্ট্রের হাতে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। ক্ষমতার গদি, ক্ষমতার উর্দি, ক্ষমতার লাঠি, ক্ষমতার বন্দুক, সব। কিন্তু ক্ষমতা আছে বলেই তো সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকতে হবে। আজ নয়, আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ নামে এক জন মানুষ তেমন কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, শিশুসন্তানের ওপর মায়ের অসীম ক্ষমতা আছে বলেই সেই সন্তানের প্রতি তাঁর দায়িত্বও অসীম; সমাজে যাঁরা ক্ষমতাবান, তাঁদের দায়িত্বও ঠিক এই গোত্রের।
জানি, উর্দিধারীরা তিরস্কারের সুরে বলবেন, ও-সব জ্ঞানের কথা দিয়ে পুলিশগিরি করা যায় না। ঠিকই বলবেন হয়তো। উর্দি আর মানবিকতা, তেল এবং জল। তবু, জানতে ইচ্ছে করে, মাঝে মধ্যে উর্দির ফাঁক থেকে মানুষটা মুখ বের করে কি না, প্রশ্ন তোলে কি না। অন্তত আত্মসম্মানের প্রশ্ন। হাতে ক্ষমতা আছে বলে আমরা যখন অন্যকে ভয় দেখাই, হেনস্থা করি, পীড়ন করি, তখন নিজের মনুষ্যত্বেরই অসম্মান করি। আমি একটা মানুষকে আতঙ্কিত করতে পারি, তাই করলাম এর মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই, কেবল এক অ-মানবিক অহঙ্কার আছে। সেটা তো নিজের মনুষ্যত্বের পক্ষে অত্যন্ত অপমানজনক। তাই ভাবি, উর্দি, লাঠি, বন্দুক সরিয়ে ভিতরের মানুষটা কি কখনও উঁকি দেয় না, জানতে চায় না: ক্ষমতা, ক্ষমতা, তোমার আত্মসম্মান নাই?