প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রীয় অতিথির আসনে তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট আসনে থাকাকালীন দুই-দুই বার ভারত সফর করলেন, এমন একমাত্র প্রেসিডেন্টও তিনিই। সেই বারাক ওবামার মুখে শোনা গেল বিরাট স্বস্তির শ্বাস: ‘আমাকে যে এ বার নাচতে হল না, এ জন্যও আপনাকে ধন্যবাদ।’
ঘন ঘন উষ্ণ আলিঙ্গন, ক্ষণে ক্ষণে নিজের হিন্দি জ্ঞানের গোপন ভাণ্ডার উজাড় করে দেওয়া: এক অসাধারণ সফরের অসাধারণ কোরিয়োগ্রাফিটা কি তা হলে ওবামা ঠিক দেখতে পেলেন না? প্রতিটি পদক্ষেপ, তার প্রতি ছন্দ যে একেবারে নিখুঁত ভাবে মাপা! প্রেসিডেন্টের কাপে চা ঢেলে দিচ্ছেন চায়েওয়ালার সন্তান। হায়দরাবাদ হাউস ঘিরে দু’জনের মৃদুমন্দ পায়চারি মুহূর্তে বিশ্বে সম্প্রচার। সর্ষে মাছ, গুশতবা, আচারি পনির: জিভে-জল-আনা মেনু। সম্প্রতি কালে সিক্রেট সার্ভিসের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথাটি ঘটিয়ে খোলা রাজপথে দু’ঘন্টা মার্কিন প্রেসিডেন্টের বসে থাকা। প্যারেড চলাকালীন বৃষ্টিঝরা আকাশে রুশ এমআই-৩৫ হেলিকপ্টার আর বৃষ্টিভেজা মাটিতে রুশ টি-৯০ ট্যাঙ্কের দাপট প্রদর্শন। আর সেই প্রদর্শনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই মার্কিন পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতির প্রবাহ, যার অর্থ, ভবিষ্যতে এই প্যারেডে দেখা যাবে মার্কিন ছাপের সাঁজোয়া গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র!
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যকাল শেষের মুখে, তিনি এখন, যাকে বলে, ‘লেম-ডাক’। ওয়াশিংটন ডিসি-তে তাঁর বন্ধু এখন হাতে-গোনা। অন্য দেশের রাজধানীতে বন্ধুর সংখ্যা তো আরও অনেক কম। কিন্তু, তবুও, দিল্লিতে এসে তিনি এক যথার্থ নৃত্যসঙ্গী খুঁজে পেলেন: ‘ব্যারি’ ও ‘ন্যারি’-র পরিবেশনা প্রথম থেকে শেষ সুঠাম ছন্দে-বাঁধা। তাল কাটে না এক বারও।
তবে কূটনীতির নৃত্য পরিবেশনকে কিন্তু লঘু করে দেখা অনুচিত। খোবরাগাড়ে-কে নিয়ে দুই দেশের যে মনান্তর সাম্প্রতিক অতীতে, এই দিয়েই তো তার থেকে বেরিয়ে আসা গেল। এই নৃত্য-পদক্ষেপের উপর ভর করেই ওবামার সাম্প্রতিক বিদেশনীতির মূল সূত্রগুলিও প্রকাশিত হল: চিন, রাশিয়া, পাকিস্তান, অথ ত্রিমূর্তি বিষয়ে। এই পথেই প্রতিষ্ঠিত হল যে, ভারতের সঙ্গে মিত্রতা আসলে ওবামার কূটনৈতিক হ্যাটট্রিক: এক দানে তিন শত্রু-দেশকে ঘায়েল করার অস্ত্র! শুধু এই জন্যই কিন্তু সফরের সমস্ত চা এবং ‘চা-চা-চা’ নৃত্যছন্দ সার্থক!
ওবামা নিশ্চয়ই জানেন, ভারতের যে কোনও প্রোডাকশনেই নাচ-গানের ভূমিকাটা কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনটি বড় বিষয়কে ঘিরে ঘুরে চলল এই জমাটি আসর। প্রথম বিষয়, ক্ষিতি। দ্বিতীয়, মরুত্। তৃতীয়, তেজ।
‘ক্ষিতি’র কথাই প্রথমে। সবাই জানে, পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে প্রতিদিন। ২০১৪ নাকি মানুষের জ্ঞাত ইতিহাস-কালের মধ্যে উষ্ণতম বছর। এই বছর শেষ দিকে প্যারিসে পরিবেশ-বৈঠক। ভারতের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে এমনিতেই গুরুতর। পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে ভারতের স্থান তৃতীয়। যে হারে তা বাড়ছে তাতে নাকি কিছু দিনের মধ্যেই চিন ও আমেরিকাকে টপকে সে হবে প্রথম, এবং হারাতে বসবে তার নিজেরই মাথার দুর্মূল্য মণি, অর্থাত্, হিমালয়ের বরফ যাবে গলে। অন্য দিকে ভাসমান বস্তুকণা (particulate matter) জনিত বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে পিএম ২.৫ নামক বস্তুকণাটির মাত্রায় দিল্লি এর মধ্যেই বিশ্বের প্রথম শহর। পটনা দ্রুত হতে চলেছে দ্বিতীয়। ডব্লিউএইচও বস্তুকণার যে সহনসীমা ধার্য করে দিয়েছে, দিল্লি ও পটনার বায়ুস্তরে বস্তুকণা তার থেকে অন্তত ছয় গুণ বেশি। পিএম ২.৫ দুনিয়ার যে ২০টি শহরে সর্বাধিক, তার অর্ধেকই ভারতে। এই প্রেক্ষিতে, ওবামার সফরে বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ারই কথা ছিল। মনে করানোর কথা ছিল যে প্যারিস বৈঠকের আগে ভারত সরকারকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা করতে হবে।
কিন্তু কী হল শেষে? চিনের সঙ্গে আমেরিকার যে ঐতিহাসিক পরিবেশ চুক্তি দেখা গিয়েছে, তার কাছাকাছিও যাওয়া গেল না। দিল্লির আলোচনায় শেষ পর্যন্ত যা হল, সেটা হল ভারতের ‘ক্লিন এনার্জি’ বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানির প্রয়োজনে একটা বিবর্ণ, ম্যাড়মেড়ে সমর্থন। মার্কিন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাঙ্ক থেকে একশো কোটি ডলার যাবে সেই সব মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, যারা ভারতে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি পাঠাতে রাজি। ভারতে ‘ক্লিন এনার্জি’ তৈরিতে বেসরকারি পুঁজি আনতে ঠিক কী কী করণীয়, তা বোঝার জন্য এই গ্রীষ্মকালে এক জন ফিল্ড অফিসারকে পাঠাবে ইউ এস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। প্রসঙ্গত, মার্কিন রফতানির প্রসারের জন্য সে দেশের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাঙ্ক এখন মোট ২৭৯০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করতে পারে।
সত্যি কথা বলতে গেলে, ওবামা যা দাবি করছেন, তার অনেকটা সত্যি। মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল মানার ব্যাপারে, এবং হাইড্রো-ফ্লুয়োরোকার্বন আস্তে আস্তে কমানোর ব্যাপারে ভারতকে রাজি করানোর বিষয়ে একটু ‘এগোনো’ গিয়েছে তো বটেই। তবে কি না, এই ‘এগোনো’ শব্দটার মধ্যে এক ধরনের ব্যঙ্গ আছে অর্থাত্ যা-ই ঘটুক না কেন, কোনও না কোনও ভাবে সেটাকে এই শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবেই। অবশ্য তার সঙ্গে কূটনীতির একটা অতি-পরিচিত দুমুখোপনাও এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। পরিবেশবাদীরা নেচে ওঠার আগে নিশ্চয়ই মনে রাখছেন সেটা!
এ বার আসা যাক ‘মরুত্’ প্রসঙ্গে। প্রেসিডেন্ট এক পাক নেচে নিয়েছেন এই নিয়েও। তাঁর সফরের ঠিক আগেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি গুরুতর ঘোষণা করেছিল। ভূপাল গ্যাস কেলেঙ্কারির ফলে যাঁরা পঙ্গু বা বিপর্যস্ত, তাঁদের প্রতি সুবিচারের প্রস্তাবটা তাই ওবামার মাধ্যমেই এল। প্রথমে ইউনিয়ন কার্বাইড, পরে ডাও কেমিক্যালস নামে যে মার্কিন কোম্পানি দীর্ঘ কাল ধরে ভারতীয় আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করে দায়িত্ব অস্বীকার করে আসছে, দূষণমূক্তির ব্যবস্থা ও বিপর্যয়ে আক্রান্ত মানুষের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করেই বেমালুম পার পেয়ে যাচ্ছে, ‘তা এক্ষুনি বন্ধ হওয়া দরকার। ভারতীয় ও মার্কিন পক্ষ ভূপালের মানুষের ন্যায্য পাওনা বহু দিন ফাঁকি দিয়ে আসছে। ভারত সরকার যেন দ্রুত ঠিক পদক্ষেপ নেয়’: অ্যামনেস্টির বার্তাটি স্পষ্টই ছিল।
মোদী ও ওবামা যদি ভূপাল বিষয়ে আর কিছু আদানপ্রদান করে থাকেন, নিশ্চয়ই গোপনে সে সব হয়েছে। সামনে থেকে আর যা দেখা গেল, তা হল অতি গুরুতর, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া একটা চুক্তি। এখানেও দেখা গেল ‘নাচ’-এর বেশ জম্পেশ স্টাইল। দ্বিতীয় বিষয় ‘মরুত্’ ও তৃতীয় বিষয় ‘তেজ’-এর মধ্যে দূরত্ব রাখার প্রয়াসেই দরকার পড়ল এই স্টাইলটার।
সন্দেহ নেই, এই শেষ বিষয়টি নিয়ে আগামী কিছু কাল অনবরত চর্চা চলবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বাঁধা পড়ল যে পরমাণু চুক্তির গাঁটছড়ায়, তাতে ভারতের ‘নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি’ বা পরমাণু দায়বদ্ধতা আইনগুলি অপরিবর্তিত রইল, তবে নতুন বোঝাপড়া হল দুই দেশের সম্মিলিত বিমা নীতি নিয়ে, এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ‘মেমোরান্ডাম ল’ তৈরির আশ্বাসও দিল ভারত।
দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূপাল এর পরও হয়তো ক্ষতস্থান হয়েই রইবে। জাপানিদের ফুকুশিমা দাইইচি পরমাণু শক্তিকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার দৃষ্টান্ত তো আছেই। মার্কিন কোম্পানির সিইও-দের কি তবে কোম্পানির উকিলরা ঠেলে ভারতে পাঠাবেন? ভারত কি তাতে একটুও আশ্বস্ত বোধ করবে? সিইও ও উকিলদের শুনতে বেশি ভাল না লাগলেও মার্কিন কোম্পানিগুলির কাছে কিন্তু ইতিমধ্যেই নির্দেশ গিয়েছে, নিজেদের ঝুঁকি মাপার কাজটা সাবধানে করার জন্য। লক্ষণীয়, এই ‘ঝুঁকি’ কিন্তু কেবল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। আরও একটা ঝঁুকি আছে। কে জানে, ভারতের কাছে হয়তো পরমাণু শক্তি অর্থনৈতিক ভাবে অতটা লাভজনক দাঁড়াবে না। কয়লাথেকে তৈরি বিদ্যুত্ ভারতে যে দামে পাওয়া যায়, খুব কম দেশেই তা মেলে। পেট্রোলের দামও ঐতিহাসিক নিম্নরেখায় এখন। পরমাণু শক্তি চুক্তির আকর্ষণ শেষ পর্যন্ত কতখানি নিটোল থাকবে, এখনই কে বলবে!
‘শেষ পর্যন্ত কোম্পানিদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে, তারা এগোতে চায় কি না,’ বললেন ওবামা। ‘এইটুকু বলতে পারি, দুই দেশের সরকার অনেকটা পথ হেঁঁটে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।’
অনেকটা পথ, সন্দেহ নেই। সম্প্রতি এশিয়া সোসাইটির একটি পুরস্কার কমিটির বিচারক হতে হয়েছিল আমায়। তাতে ২০১৪ সালের সেরা হিসেবে পছন্দ করলাম ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে একটি বই। বইটি ভাল লাগার কারণ হল, ভারত-মার্কিন সম্পর্কের তলানিতে পৌঁছনোর যুগটাকে বেশ অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়া গেল: হ্যঁা, সেই নিক্সন-কিসিঙ্গারের যুগ। ওবামা-কেরি যে কত দূর, কত পথ হেঁটে এসেছেন, মনে পড়ে গেল আবার।
সুতরাং, ওবামা তাঁর ছোট্ট ঘটনাবহুল ভারত সফরে ভালই নৃত্য-পারঙ্গমতা দেখালেন। দুরূহ আলোচ্য সব বিষয়: তাই বিষয়গুলি ঘিরে নৃত্যের শৈলী, পদক্ষেপ, ভঙ্গিমা সবই তাঁকে ভাল করে শেখানো হয়েছিল। পরের স্টপ সৌদি আরবেও এই শিক্ষা কাজে লেগেছে নিশ্চয়। আর, ওয়াশিংটন ডিসি-তে যদি এখনও তাঁর কিছু বন্ধু তৈরির আশা থেকে থাকে, তবে সেখানেও এ শিক্ষা কাজে লাগানোর কথা তিনি ভেবে দেখবেন নিশ্চয়ই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি-র ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ও ফিনান্স-এর অ্যাসোসিয়েট ডিন