ক্ষমতাসীন দল বা ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটিলেই শাসনপ্রণালীতেও পালাবদল ঘটিবে, এমন কোনও কথা নাই। সচরাচর ক্ষমতাসীন রাজনীতিক বা দল পাল্টাইয়া গেলেও ক্ষমতার ভাষা, প্রণালী ও পদ্ধতি একই থাকিয়া যায়, পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিলাইয়া যায়। তাই শ্রীলঙ্কায় মহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত ভাবে পরাস্ত হইলেও তাঁহারই দলের নেতা মৈত্রীপাল সিরিসেনা যে অন্য পথে হাঁটিবেন, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। দ্বীপভূমির তামিল জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ কালের স্বশাসনের দাবিটির ক্ষেত্রে তিনি তাঁহার পূর্বসূরিদের পদাঙ্কই অনুসরণ করিবেন, এমনই আশঙ্কা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালের নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংঘে জানাইয়াছেন, উত্তর ও পূর্ব শ্রীলঙ্কার তামিল প্রদেশে পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের যে-প্রস্তাব সংবিধানের ১৩ নম্বর সংশোধনীতে প্রতিশ্রুত ছিল, তাহা পালন করা হইবে। অস্যার্থ, ওই প্রদেশের নির্বাচিত শাসক দল তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়ান্স-এর (টিএনএ) মুখ্য দাবিটি মানিয়া লওয়া হইবে।
ইতিবাচক ঘটনা। তামিল প্রদেশকে আরও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আর্থিক তহবিল মঞ্জুর করার প্রস্তাবটি পুরানো। ১৯৮৭ সালে ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তির মধ্য দিয়া জাতিবৈর সমস্যার সমাধানে এই প্রস্তাব প্রণীত হয় এবং শ্রীলঙ্কার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসাবে নথিভুক্ত হয়। কিন্তু তদবধি কোনও সরকারই ইহা পালন করে নাই। এলটিটিই-র বিরুদ্ধে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, গেরিলাদের পরাজয় ও নিশ্চিহ্নকরণ এবং অসামরিক তামিল জনগোষ্ঠীর শরণার্থীতে পরিণত হওয়ার পর দাবিটি তুলিবার লোকও ছিল না। রাজাপক্ষে সরকার তো তামিল-দমনে এতটাই অনমনীয় ছিলেন যে, তামিল-অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্ব প্রদেশকে সামরিক শাসনে মুড়িয়া ফেলেন। উত্তরের জাফনা প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হইলেও নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে কোনও ক্ষমতা অর্পণেই তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। ওই প্রদেশের গভর্নর পদেও এক অনুগত সামরিক প্রশাসককে বসাইয়া দেন। টিএনএ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সি ভি বিঘ্নেশ্বরন-এর সহিত এই গভর্নর এবং রাজাপক্ষে নিযুক্ত মুখ্য সচিবের বিরোধ এত বিদ্বেষপূর্ণ হইয়া ওঠে যে, উত্তর প্রদেশ সুষ্ঠু শাসন দুরূহ হইয়া পড়ে। বিক্রমসিংঘে যে দ্রুত দ্বন্দ্বের অবসান চাহেন, তাঁহার ঘোষণায় তাহা স্পষ্ট। প্রদেশের গভর্নর ও স্বরাষ্ট্রসচিব পরিবর্তনের উদ্যোগও শুরু হইয়াছে।
এ সবই সুলক্ষণ। শ্রীলঙ্কার তামিলরা স্বতন্ত্র ইলম অর্থাত্ সার্বভৌম তামিল রাষ্ট্রের দুঃস্বপ্ন হইতে সম্ভবত এত দিনে জাগিয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু জাতিসত্তা হিসাবে সিংহলি জনগোষ্ঠী ও তাহার নিয়ন্ত্রিত সরকারের কাছ হইতে যে বঞ্চনা ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব তাঁহারা এত কাল পাইয়াছেন, তাহা ঘুচাইবার সদিচ্ছা ও প্রক্রিয়া যদি সূচিত হয়, তাহাই কালক্রমে ইলমের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস করিবে। সকল তামিলকে এলটিটিই-র সমর্থক গণ্য করিয়া তদনুযায়ী তাঁহাদের সহিত আচরণ করার অপশাসন হইতে প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালের সরকার বাহির হইতে উন্মুখ। এই সরকারকে তামিলদের আস্থা অর্জন করিতে হইবে। তামিল-অধ্যুষিত জেলাগুলিতে যুদ্ধ-ধ্বস্ত পরিকাঠামোর উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার দিকে সরকার মনোযোগী হউক। তামিলরা বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ হইতে ফিরিয়াছেন, এ বার সিংহলিরাও সংহতির হাত বাড়াইয়া দিন।