আবার এসেছি ফিরে। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে রামবিলাস পাসওয়ান। গয়া। ছবি: পিটিআই।
১৯৫২ থেকে পর পর নির্বাচনগুলোতে ব্যক্তি-নেতা-দলের অবস্থান, প্রচারের বিষয়-কৌশল, ভোটারকে টানা ইত্যাদিতে ক্রমাগত বিবর্তন এসেছে। সূচনাপর্বে দলগুলোর মতবাদকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রচারের ধারায় জনমনে দল ও নেতা সম্পর্কে একটা মতাদর্শ-ভিত্তিক ভাবমূর্তি তৈরি হত। আয়ারাম-গয়ারামের দলে নাম লেখানোর ঘটনা ছিল বিরল, এবং তেমন আচরণকে জনগণ বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করতেন। তার পরে ক্রমশ যুগ বদলেছে। কিন্তু এবারকার নির্বাচনে দলবদলের যে হিড়িক ও ধরন, তা চমকপ্রদ। এই নতুন ধারার প্রবল প্রবাহে দল, নেতাদের অবস্থান, বিশ্বাস ও প্রথাগত চেনা ছক ভেঙে তছনছ। আয়ারাম গয়ারামই যেন রীতি।
ভারতীয় গণতন্ত্রের এ এক বড় পরীক্ষা। দীর্ঘলালিত বিশ্বাস, নীতি, আদর্শকে অবলীলায় গুডবাই জানিয়ে ভারী ভারী নেতারা স্রোতের মতো কে কোন দলে যাচ্ছেন, আসছেন, কাল কোথায় যাবেন কেউ জানে না। তাঁরা নিজেরাও হয়তো না। আজ যা বলছেন, কাল বলছেন তার বিপরীত। রাজনীতির মেলায় চলছে যেমন খুশি তেমন চলা, নীতি বা মতবাদ কোনও বাধাই নয়। চলছে অবিরাম দলবদল, চলছে অন্তর্ভুক্তি বহিষ্কারের প্লাবন। এরই মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে নায়ক, গায়ক, ভাবুক, খেলোয়াড়, জাদুকর, শিল্পী মাঠে নেমে পড়েছেন। নায়িকারা পরদা থেকে আটপৌরে শাড়ি পরে নতুন মঞ্চে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বুদ্ধিজীবীরাও বুদ্ধি বদলে অনায়াসে এ শিবির থেকে ও শিবিরে ভিড়ে যাচ্ছেন। রাজনীতি এখন নলিনীদলগত জলবত্।
ধর্মনিরপেক্ষতার জিগিরে মূর্ছাবায়ুগ্রস্ত দলগুলোর কাছে বিজেপি নাকি সংক্রামক রোগে আক্রান্তের মতো পরিত্যাজ্য। এমন বিশ্বাসে গভীর বিশ্বাসী জগদম্বিকা পাল, সত্পাল সিংহ মহারাজ, কর্নেল সোনারাম চৌধুরী, এম জে আকবরের মতো ভারী ভারী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা কত সহজেই সেই দলে নাম লিখিয়ে ফেললেন। মাত্র সে দিন এনডিএ-কে সাম্প্রদায়িক ছাপ মেরে ধর্মনিরপেক্ষতার পবিত্র আলোয় উত্তীর্ণ রামবিলাস পাসওয়ানজি দলবল-সহ আবার মহাসমারোহে তাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধে ফেললেন। আগমার্কা ধর্মনিরপেক্ষ লালুপ্রসাদের এম-ওয়াই ফর্মুলার বিশ্বস্ত সমর্থক রামকৃপাল সিংহ যাদব রাজনাথ সিংহের কোল আলো করে নবজন্ম নিলেন। এনডিএ-কে ঝেড়ে ফেলে সদ্য পরিস্রুত ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলি পরিহিত নীতিশজির ভাবশিষ্য এন কে সিংহ, শিবানন্দ তেওয়ারি, সাবির আলিরাও সে দিকেই হাঁটি হাঁটি পা পা। চন্দ্রবাবু নায়ডু সহসা এন ডি এ’র নতুন অতিথি। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী জাফর শরিফ হঠাত্ আবিষ্কার করলেন কংগ্রেস যথেষ্ট নিরপেক্ষ নয়, নাম লিখিয়ে ফেললেন জনতা দল সেকুলারে। এ তো হিমশৈলের ভাসমান শীর্ষদেশ, তলদেশে তৃণমূল স্তরে এই পালাবদলের পরিমাণ ও গতিবেগ কত, তার হিসেব করতে যন্ত্রগণকও যথেষ্ট নয়।
সকল দলেরই অভ্যর্থনাগৃহে সর্বদা লাল কার্পেট বিছানো। আগন্তুক যে দল যে বিশ্বাস থেকেই আসুক, উষ্ণ সংবর্ধনা নিশ্চিত। রঙে কিছু আসে যায় না, ইঁদুর ধরতে পারলেই হল। উপহার ওজন বুঝে। হয় একটি টিকিট, নয় একটি পদের আশ্বাস। বিজেপি-র বাজার তেজি। শেয়ার মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। আরও তেজি করতে চাই নতুন মুখ, নতুন রক্ত। সংখ্যালঘু হলে টপ প্রায়রিটি, কালি ঢাকতে হোয়াইটনারের কাজ করবে। এলজেপি হয়ে জেডিইউ-তে সদ্য-আসা সাবির আলি মোদীর প্রশংসা করে বহিষ্কৃত? বিছিয়ে দাও লাল কার্পেট। ও দিকে ভ্যালেন্টাইন দিবসে পাব-রেস্তোরাঁয় কুত্সিত আক্রমণে অভিযুক্ত প্রমোদ মুথালিক ইঁদুর ধরার ক্ষমতা রাখেন। দাও সদস্যপদ। আবার দলের প্রবীণদের কেউ বললেন সাবির সন্ত্রাসবাদী ভটকলের সহচর, কেউ বললেন মুথালিকের নামে রয়েছে ৪৫টি বিশ্রী মামলা। ভোটারদের হজম হবে না। বাতিল করো সদস্যপদ। অন্তর্ভুক্তি বাতিল হল বিদ্যুত্গতিতে। একদা দলের স্তম্ভ ইয়েদুরাপ্পা বেলাড়ী কাণ্ডের কলঙ্কমোচনে দলের সাহায্য না পেয়ে অভিমানে গৃহত্যাগী। এখন ক্রান্তিকাল। ভাঙাও অভিমান। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরুক। সুষমা স্বরাজের আপত্তি? তিনি তো আডবাণীর ছায়াসঙ্গী। এ সবে এখন গুরুত্ব না দিলেও চলবে। নমো নমো।
অন্য শিবিরে নজিরবিহীন বৈরাগ্য। সর্বত্র ভাটার টান। বর্ষীয়ান নেতাদের সন্ন্যাস গ্রহণের আকুলতা তুঙ্গে। মনমোহনজি বানপ্রস্থ ঘোষণা করেছেন। অভিজ্ঞ অ্যান্টনি, চিদম্বরম, আইয়ার, দিগ্বিজয়, মইলিরা গা ছাড়া। প্রধানমন্ত্রিত্বেও রুচি নেই, সাংসদের টিকিট তো হাতের ময়লা। মওত কা সওদাগরকে জিওন কা দূত মেনে নিয়ে অনেকে গৃহত্যাগী হয়েছেন, যাঁরা রয়েছেন তাঁদেরও টিকিট নিতে প্রবল অনীহা। সবাই চাইছেন পদ ছাড়াই দলের সেবায় প্রাণপাত করতে। কেউ বলছেন বয়স বেড়েছে। কেউ সাংসদ হওয়ার চেয়ে উচ্চ রক্তচাপে অসুস্থ স্ত্রীর সেবাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। কারও হৃত্পিণ্ডের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। হাইকম্যান্ডের ধমকে অনেকে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু ভাবটা হল, খিদে নেই, দিচ্ছ তাই খাচ্ছি। ব্যতিক্রম অবশ্য আছেন। কমনওয়েলথ গেমস খ্যাত কালমাডি বলছেন, চুরির দায়ে অভিযুক্ত বনশল যদি টিকিট পেতে পারেন, তিনি পারেন না কেন? পঞ্জাবের দুই নেতা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ আর প্রতাপ সিংহ বাজওয়ার সম্পর্ক অহিনকুল। অথচ নিজেদের দাবি ছেড়ে উভয়ে উভয়কে উপহার দিতে চাইছেন জেটলির বিরুদ্ধে অমৃতসর, প্রতাপ সিংহ বাদলের বিরুদ্ধে ভাতিন্দার আসন। বড়োদরায় মোদীর বিরুদ্ধে মনোনীত কংগ্রেস প্রার্থী নরেন্দ্র রাওয়াত আর্জি জানালেন, তিনি এ কেন্দ্রে দুর্বল, আরও শক্ত প্রার্থী দেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল মধুসূদন মিস্ত্রিকে। বারাণসীতে শেষ পর্যন্ত পুরনো চালই ভরসা বলে সাব্যস্ত হল। সাংসদ হওয়া মানেই যেখানে মোটামুটি রাজত্ব পাওয়া, সেখানে এই বিনয়, বৈরাগ্য, আত্মমূল্যায়ন, পদের প্রতি এমন উঁচু মার্গের উদাসীনতা নতুন বটে।
আঞ্চলিক দলগুলো মোনালিসার দুর্বোধ্য হাসিমুখে দেওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে। জোটফোট, ন্যূনতম কর্মসূচি, মতাদর্শগত নৈকট্য ইত্যাদির বিবেচনা এখন অতীত। সব নৌকোর পথ রাখাই রীতি। রং এখানেও গৌণ। ব্ল্যাকমেলিং পাওয়ার বাড়িয়ে সর্বাধিক মাংস খুবলে নেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় সবাই প্রহর গুনছে। ফেডারেল ফ্রন্ট থার্ড ফ্রন্ট এখন কার্যত হন্টেড হাউস।
প্রেমে ও যুদ্ধে কোনও কিছুই অশোভন নয়। তা যে রাজনীতিতেও প্রযোজ্য, সেটা এ বার আরও উজ্জ্বল হল। জয়ললিতা সিপিএম গাঁটছড়া হল, জল না শুকোতেই বাতিল। থার্ডফ্রন্টের আসর আলো করলেন মুলায়ম, দু’দিন পরেই ভিন্ন সুর। রাহুল-সনিয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা। বিনিময়ে কংগ্রেসও তাঁর এবং তাঁর পুত্রবধূর বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে না! থার্ডফ্রন্টের হোতাদের ঘোষণা: বিজেপি কংগ্রেসের সমদূরত্ব। রাত পোহাতেই সিপিএম-এর মুখে বেতাল সুর, প্রয়োজনে তাঁরা কংগ্রেস শিবিরে যাবেন। ফেডারেল ফ্রন্টের ভিতপুজোয় অণ্ণা-মমতা জোট হল। অণ্ণাজি মমতাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে চাইলেন। সারা দেশে বিদ্যুত্তরঙ্গ। সংবাদমাধ্যম উত্তাল, রাজনীতির জগতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। তৈরি হল রামলীলা ময়দান। এর চেয়ে ছোট জায়গায় অণ্ণা-মমতার হাই প্রোফাইল মিটিং হতেই পারে না। মিটিংয়ে মমতা এলেন, অণ্ণাজি এলেনই না। কখনও বললেন শরীর খারাপ, কখনও ফাঁকা ময়দান। কথার দাম, বোঝাপড়ার মর্যাদা মানুষ দেখল। দুর্নীতি ও প্রথাগত রাজনীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দিল্লি-কাঁপানো কেজরীবালও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কী তাঁর পরিকল্পনা, কেউ জানে না। লোকজনও জুটছে। ব্যাপক হইচই। এও এক নতুন গণতন্ত্রের মহড়া। তেলঙ্গনার চন্দ্রশেখর রাও-এর ওয়াদা ছিল তেলঙ্গানা রাজ্য হলে তাঁর দল কংগ্রেসে মিশে যাবে। টোপ গিলে কংগ্রেস সংসদকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে তেলঙ্গানা করে দিল। চন্দ্রশেখর এখন বলছেন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী না করলে মিশে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। জোট বাঁধাও অসম্ভব। সীমান্ধ্রের কংগ্রেসিরা দলে দলে ঢুকছে টিডিপি-তে। দলগুলোর অবস্থা অনেকটা প্রতিমা তৈরির কাদার ঢেলার মতো। কোন দেবীর প্রতিমা হবে, কেউ জানে না।
দলগত লড়াইয়ের প্রথায় গুডবাই। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত। এক দিকে রাহুল, অন্য দিকে মোদী। দল গৌণ। লড়াইয়ের মুখ্য বিষয় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িকতা। বেকারি, দারিদ্র, জাতীয় ইস্যু ইত্যাদির স্থান শুধু ইস্তাহারে। দুই মুখ্য স্রোতেই আবর্তিত প্রাক-নির্বাচনী প্রচার। তত্ত্ব বা দর্শনের স্থান নেই। ব্যক্তি বা ঘটনাই প্রাসঙ্গিক। হোক না তা শতাব্দী-প্রাচীন। ব্যবহার করতে পারলে এখনও সুফল দিতে পারে। কেউ টেনে আনছেন গাঁধী-হত্যা, কেউ অপারেশন ব্লু স্টার। কেউ গোধরা, কেউ দিল্লি। কেউ বলছেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নপুংসক, কেউ বলছেন তাঁকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলবেন। কেউ বলছেন বিপরীত দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নাবালক, অপরিপক্ব। বংশতান্ত্রিক। মোদী বলছেন ৬৫ বছরে যা উন্নতি হয়নি, পাঁচ বছরে তা করে দেখাবেন। দুর্নীতি হঠাবেন। সনিয়া বলছেন ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই চালাবেন, দুর্নীতি বিরোধী কঠোর আইন আনবেন। তাঁরই নিকটাত্মীয়া মেনকা গাঁধী প্রশ্ন তুলেছেন, সনিয়াজি বিয়ের যৌতুক হিসেবে দু’শো টাকাও আনেননি, কী ভাবে তিনি ধনী মানুষের তালিকায় ষষ্ঠ হয়ে উঠলেন? তিনি দুর্নীতি হঠাবেন কী করে?
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক, জাতীয় কোনও দর্শনের দিশা কারও বক্তব্যে নেই। নীতি আদর্শের প্রতি আনুগত্যের আহ্বান নেই। রুচিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণই প্রচারের মূল উপাদান। দল ও নেতাদের এমন দেউলিয়াপনা এর আগে এমন উলঙ্গ স্বীকৃতি পায়নি। প্রতিষ্ঠিত দল ও নেতাদের প্রতি সাধারণ মানুষের এমন বিতৃষ্ণা ও অবিশ্বাসের বিস্ফোরণও এ দেশ আগে দেখেনি। ইন্টারনেট প্রযুক্তি মারফত তা আজ ঘরে ঘরে নিনাদিত। তরুণ সমাজের ভাবনাও ছায়াবৃত। এই প্রথম এক জন দল নিরপেক্ষ প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। নোটা ‘কাউকেই পছন্দ নয়’ জানানোর সুযোগ। সব প্রবণতার বিচারে বলা যায়, এই নির্বাচন ঐতিহাসিক হতে চলেছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ চেহারার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে আনবে। ভাল মন্দ বিচার করবে ইতিহাস। তবে ভাঙনের লক্ষণ বড় প্রকট।