জনশিক্ষার ক্ষেত্রে (ভারত)রাষ্ট্রকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে, যা অধিকাংশ সভ্য দেশের সরকার পালন করে চলেছে...।’ ১৮ মার্চ ১৯১০, ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের দাবি তুলেছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন বিদেশি শাসনে নৈতিক দায়িত্বের মূল্য নেই, সুতরাং ‘লক্ষ লক্ষ শিশুর শিক্ষার অধিকার’টাকে আইন করেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। হয়তো বা ভেবেছিলেন, স্বাধীনতার পরেও নেতারা ‘সভ্য দেশের’ নেতাদের মতো আচরণ না-ও করতে পারেন, তাই পরাধীন অবস্থাতেই স্বক্ষমতা প্রসারী এই মৌলিক ব্যাপারটাকে বাধ্যতামূলক আইনে বেঁধে ফেলা ভাল।
ব্রিটিশ সরকার গোখলের দাবি মানেনি। কিন্তু স্বাধীন দেশের সরকার? সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থায় সে ব্যর্থ হল, এ নিয়ে আইন করতেও কেটে গেল গোখলের দাবি উত্থাপনের পর ঠিক একশো বছর। ২০০৯ সালটা গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরই ৪ অগস্ট, পঞ্চদশ লোকসভার সদ্য-নির্বাচিত সদস্যরা শিক্ষার অধিকার আইন পাশ করেন, ১ এপ্রিল ২০১০ যা বলবত্ হল। সেই সংসদের মেয়াদ ফুরোল, ষোড়শ লোকসভায় আসন গ্রহণের জন্য অধুনা প্রবল ঘর্মস্রাব, সান-ক্রিম, সরবত, ডাবের জল, রাজদৌড়। এমন ঘোর-লাগানো উত্তেজনার কালে শিক্ষার অধিকার আইনটার কী হল, সে প্রশ্ন তোলা রসভঙ্গ ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু রাজনেতাদের বদ ও ক্রূর রসিকতার মাঝে একটু বেয়াড়া রসভঙ্গ করলেও তাঁরা নিশ্চয়ই নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
গোটা দেশের খবরে কাজ নেই। আমরা বঙ্গবাসী, আর গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলে গেছেন, ‘বাংলা আজ যা ভাবে...’ বস্তুত, ওই উদ্ধৃতিটার জন্যই আমরা তাঁকে চিনি। শিক্ষার অধিকারের সঙ্গে তাঁর যোগটা স্মরণে রাখার মতো মূর্খ যে আমরা নই, তা এ রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা থেকেই স্পষ্ট। আইন থাক বা না থাক, সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা যে একটা নৈতিক কর্তব্য, তা এ রাজ্যের শাসকরা কখনওই মনে করেননি। দশকের পর দশক লক্ষ লক্ষ শিশু বিদ্যালয়শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে নিরক্ষর প্রাপ্তবয়স্ক জীবন কাটিয়ে গেছে, প্রায়শই দিনমজুরি করে। অবশেষে যখন আইন হল, তা নিয়েও এ রাজ্যের তত্কালীন শাসকদের গলায় মিহি হতাশা। ’৭৭ সালে যাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রথম দফাগুলোর অন্যতম ছিল সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুতির কালেও সেটা গবেষণার পাদটীকা থেকে গেল। এল নতুন সরকার, নতুন অঙ্গীকার, শিক্ষাগ্রহীরা আশায় বুক বাঁধলেন: পরিবর্তন হবে। কিন্তু স্থূলে ভুল ছিল। আমরা যে বঙ্গবাসী। শিক্ষার ব্যাপারে পরিবর্তিত জমানাতেও অপরিবর্তনের মানসিক জাড্য। শুধু লোকশ্রুতি নয়, সরকারি নথিপত্রও তা-ই বলে।
শিক্ষাক্ষেত্রে রিসোর্স বা সংসাধনের অভাবটা নতুন কথা নয়। কিন্তু সমস্যা তো শুধু সংসাধনের নয়। যেটুকু আছে, সেটাকে কতটা দক্ষতা ও ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে? দুঃখের বলুন আর গ্লানির বলুন, পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বড় অপরিবর্তন হল সংসাধন ব্যবহারে অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা এবং অন্যায্যতা। যার ফল হিসেবে রাজ্যবাসীর একটা অংশ, যাঁরা সর্বাপেক্ষা অসহায়, তাঁরা বরাবর বঞ্চিত থেকে এসেছেন। এঁরা সামাজিক পরিচিতির দিক দিয়ে সুযোগবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলির সদস্য (মুসলমান, আদিবাসী, দলিত) এবং অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনে সবচেয়ে নীচের তলার বাসিন্দা (খেতমজুর এবং অন্যান্য ঘর্মজীবী)। বিবৃতিটির পক্ষে প্রমাণ অঢেল, কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি দিক নিয়ে আলোচনাই যথেষ্ট।
প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, ‘মাস্টাররা পড়ান না’। এ অভিযোগে সত্যাসত্যের সম্মিলন। কিন্তু প্রথম প্রশ্ন, সর্বত্র কি পড়াবার লোক আছেন? সে দিন সংবাদ শিরোনাম: ‘এক জন শিক্ষক, ১৩৫ ছাত্রছাত্রী।’ হয়তো বলবেন, ‘ও একটা আধটা ব্যতিক্রম।’ তা যে নয়, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের তথ্যগুলোই প্রমাণ করে। এখনও রাজ্যে ৪৮০টি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ১০০-র ওপরে। বহু দিন ধরে এমনটাই চলে এসেছে, কিছু স্কুলে শিক্ষক নেই, আবার কিছু স্কুলে দরকারের চেয়েও বেশি। ঠিক এই কারণে, বিগত সরকারের শেষের দিকে শুরু হওয়া এবং বর্তমান আমলে জারি হওয়া শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি গতিশীল থাকা সত্ত্বেও এবং গড়ের হিসেবে শিক্ষকের ঘাটতি অনেকটা মিটলেও আসল সমস্যার সমাধান হয়নি। ২০০৪-এ এ রাজ্যে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ছিল ৫৩, এখন ২৯। উন্নতি বটে, কিন্তু সে তো গড়ের হিসেব, ভিতরের খানাখন্দগুলো? ২০০৪-এ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের জেলাগত তারতম্য ছিল সর্বনিম্ন ৩৫, সর্বোচ্চ ৮৭। আজ সেটা সর্বনিম্ন ১৪, সর্বোচ্চ ৪০! দশটি জেলায় এই অনুপাত রাজ্য গড়ের উপরে। ৩৪৫ ব্লকের ১৭৩টিতে এই অনুপাত রাজ্য গড়ের উপরে।
বৈষম্যের সূচক হিসেবে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতটি জনবহুল এলাকাতে (মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি) বেশি প্রাসঙ্গিক। জনবিরল (যেমন, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ইত্যাদি) এলাকাতে বৈষম্যের অন্য একটি সূচক দেখা শ্রেয়। এটি হল, এক জন মাত্র শিক্ষকের উপর ভর করে চলা স্কুলের সংখ্যা বা অনুপাত। আজও এ রাজ্যে ১৮০০-এর বেশি প্রাথমিক স্কুলেই এক জন মাত্র শিক্ষক। প্যারাটিচারদের এ হিসাব থেকে বাদ দিলে সংখ্যাটা চলে যায় ৩০০০-এর ওপর! এর অধিকাংশই ৩৬টি ব্লকে, যেগুলিতে একশিক্ষক স্কুলের অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি। লক্ষণীয়, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কমানোর পিছনে প্যারাটিচারের সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ; রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রায় ১৩ শতাংশই প্যারাটিচার (আইনে যাঁদের মান্যতা নেই)। কতকগুলি জেলা আবার সাংঘাতিক ভাবে প্যারাটিচারনির্ভর: মালদহ (২৭%), মুর্শিদাবাদ (২৬%), শিলিগুড়ি (২৪%), উত্তর দিনাজপুর (২২%) এবং জলপাইগুড়ি (১৭%)।
শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত এবং এক-শিক্ষক স্কুল, দু’দিক দিয়েই রাজ্যের ব্লকগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, যেখানে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত বেশি (গড় ৫৬), সেখানে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য (৫৯%)। কিন্তু এখানে একটা শর্ত আছে, যেখানেই মুসলমান বেশি, সেখানেই অবস্থাটা খারাপ এমন সোজাসাপ্টা সম্পর্ক কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে মুসলমানের সঙ্গে সঙ্গে খেতমজুরের সংখ্যাও বেশি (৩৫%), কেবল সেখানেই এই সম্পর্কটা প্রতিষ্ঠিত।
শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি হিসেবে খেতমজুরদের ধরে নিয়ে বিশ্লেষণটিকে আরও একটু এগিয়ে আমরা এক-শিক্ষক স্কুলগুলো থেকেও একই রকম একটা সম্পর্ক পাচ্ছি। যে ৩৬টি ব্লকে এক-শিক্ষক স্কুলের খেতমজুরের অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি, সেই ব্লকগুলোর ২০টিতেই খেতমজুরের অনুপাত ২৫ শতাংশের বেশি। এদের ১৩টিতেই আবার আদিবাসীদের সংখ্যাধিক্য (২০%)।
আশ্চর্য নয়, যে সব জেলা শিক্ষায় গড় হিসেবে এগিয়ে আছে, যেমন পূর্ব মেদিনীপুর, সেখানেও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলো একই রকম বৈষম্যের শিকার। এই জেলাতেও এক-শিক্ষক স্কুলের অনুপাত ৭% (রাজ্য গড় ৪%; বস্তুত এ জেলায় ২০০৪-এর তুলনায় এই অনুপাত বেড়েছে)। হয়তো এ কারণেই সাক্ষরতার হারে এগিয়ে থাকলেও শিক্ষার মানের দিক দিয়ে এ জেলা কোনও ইতিবাচক পার্থক্য দেখাতে পারে না। অবশ্যই অবস্থা বদলেছে। খুব উদ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হল, কিন্তু সবচেয়ে অসহায়দের সহায়তায় তাঁদের কাজে লাগানোর ব্যাপারটা উপেক্ষিতই থেকে গেল। খেতমজুরের ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়তো পেল, পড়ার সুযোগ পেল না। আরও বড় প্রশ্ন, অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে যে যুদ্ধ-পরিস্থিতির রাজনৈতিক তত্পরতা দেখা গেছে, শিক্ষার অধিকার আইন বলবত্ হওয়ার কয়েক বছর পরও মূল সমস্যাগুলো কেন অবিকৃত থেকে গেল?
এ সব প্রশ্নের একটা ব্যাখ্যা বোধ হয় এই যে, জনগণ যাঁদের আইন প্রণয়নের জন্য পাঠান, আইন রূপায়ণে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এ দিক দিয়ে হিন্দি বলয়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বড় কোনও পার্থক্য নেই। শ্রেণি রাজনীতির পরীক্ষাগারে দুর্বলতম শ্রেণিগুলো তো পরীক্ষার নমুনামাত্র।