নিরাপত্তার দাবি। সিয়েরা লিওন, অক্টোবর ২০১৪। ছবি: গেটি ইমেজেস।
জোনা কিয়ে লাইবেরিয়ার লোফা-মানো ন্যাশনাল পার্কের কাছে তাকপইমা গ্রামে মনিহারি সামগ্রী বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। সময়টা ২০১৪’র বসন্ত কাল। গিয়ে শুনলেন, সেখানে নাকি অনেককেই ভূতে ধরছে। প্রথমে লোকেদের জ্বর হচ্ছে, আর তার পরেই তারা মরে যাচ্ছে। শুনেছিলেন বটে, বিশেষ পাত্তা দেননি। কিন্তু দেখতে দেখতে আশেপাশে লোকজন মারা যেতে থাকল। প্রাণ হাতে পালিয়ে এলেন রাজধানী মনরোভিয়ায়, নিজের বাড়িতে। জ্বর তাঁকেও ছাড়ল না। তবে সে যাত্রা রক্ষা পেলেন।
অনেকেই রক্ষা পাননি। প্রায় এক বছরে ইবোলার বলি ন’হাজার ছাড়িয়েছে। ইবোলা আফ্রিকায় নতুন রোগ নয়, তবে আগে কখনও বিশ্ব জুড়ে এতটা আতঙ্ক তৈরি করেনি। সরকারি হিসেবে এ যাত্রায় ইবোলা প্রথমে ছড়িয়েছিল গত বছর মার্চ মাসে। অবশ্য গিনির জঙ্গলে এ রোগের কথা শোনা যায় ২০১৩ ডিসেম্বরেই। প্রথমটায় ভূতপ্রেত আর দুষ্ট আত্মার কারসাজি ভেবে লোকে প্রথমে ছুটল ওঝা বা গুণিন গোছের লোকেদের কাছে, যাঁরা নাকি এ সব ভূত ছাড়াতে ওস্তাদ। নানান শুদ্ধিকরণের পরেও যখন অসুখের বহর কমার লক্ষণ দেখা গেল না, তখন মানুষ সন্দিহান হলেন, ভূতপ্রেত নয়, এটা বোধহয় কোনও অসুখ। তত দিনে ভাইরাস তার প্রতিপত্তি ছড়িয়েছে অনেক জায়গায়। তবে লাইবেরিয়া, গিনি আর সিয়েরা লিওন, তিন দেশেই বিশেষ করে ছড়াতে থাকে অসুখ। লাফিয়ে লাফিয়ে। আজ পাঁচ জন আক্রান্ত হয় তো কাল পাঁচশো।
ছড়াবেই। ডাক্তার, সমাজসেবীরা বলছিলেন, রোগীকে রাখতে হবে একেবারে আলাদা। কিন্তু প্রথম দিকে ঠিক উল্টোটাই হয়েছিল বেশি। তার কারণও ছিল। সে কালে আফ্রিকার যেমন অন্য অনেক অঞ্চলেরও— নানান জনজাতির মানুষেরা খুব বড় দুর্ভিক্ষের সময়েও কারও একটা রুটি জুটলে একশো ভাগ করে তবে খেতেন। এখন হয়তো সে দিন আর নেই, কিন্তু সংহতিবোধ এখনও প্রবল। কেউ আত্মীয়বন্ধুদের বিপদে ফেলে পালায় না বা আলাদা করে দেয় না। এত কালের ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দিয়ে ক’টা পাশ দেওয়া ডাক্তার-মোক্তারের কথা শুনতে যাবেন কেন? শোনেননি অনেকেই। আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে রোগীর কাছে থেকেছেন। আর মৃত্যুর পর তো কত রকম প্রথা মেনে স্নান করিয়ে, মন্ত্রঃপূত ওষুধ লাগিয়ে তবে অন্ত্যেষ্টি। এবং তার ফলেই রোগীর সংস্পর্শে এসে আরও অনেকে আক্রান্ত হন। ইবোলা দাবানলের চেয়ে দ্রুত ছড়াতে লাগল।
তবে কিনা বিপদ মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। যখন দেখা গেল পুরনো রীতিতে এ রোগ সামলানো যাচ্ছে না, তখন মানুষ ডাক্তারদের কথা, সমাজসেবীদের কথা শুনতে শুরু করলেন। আসলে তখন দায়। নিজে বাঁচার দায়। আমি যদি না-ও বা বাঁচি, আমার পরিবার, আমার দুধের সন্তান যেন বেঁচে থাকে। দায় থেকে এল মরিয়া উদ্যোগ। ইবোলা আটকাও। ইবোলা সম্পর্কে জানো। যার ইবোলা হয়েছে তাকে আলাদা রাখো। হাসপাতালে নিয়ে যাও। স্থানীয় মানুষ নিজেরাই উদ্যোগ করে রোগীদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, ইবোলা শিবিরে নিয়ে যেতে লাগলেন, তাঁদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করলেন। নিজেরাও সতর্ক হলেন। বাইরের দুনিয়া থেকে সাহায্য এল। অর্থ, ওষুধপত্র, অন্য ত্রাণসামগ্রী, ডাক্তার, সমাজকর্মী। যথেষ্ট এল, তা নয়। তবু, এল। বিশেষ করে আমেরিকা এবং ইউরোপে আফ্রিকা-ফেরত দু’চার জন রোগীর সন্ধান মেলার পরে, তাঁদের কেউ কেউ মারা যাওয়ার পরে পশ্চিম দুনিয়ার তত্পরতা অনেকটা বাড়ল। আস্তে আস্তে অসুখের প্রকোপ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। এরই মধ্যে ঘোষণা হল: নাইজেরিয়া, বোকো হারামের তাণ্ডবে নাজেহাল নাইজেরিয়া, ইবোলা-মুক্ত! আফ্রিকার, বিশেষ করে ওই তিনটি দেশের বিপদ এখনও কাটেনি, নতুন নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ছে। তবু এরই মধ্যে আক্রান্ত দেশগুলি চেষ্টা করছে জীবনে ফেরার, লাইবেরিয়ায় বহু দিন পরে স্কুল খুলেছে, বাচ্চারা জীবাণুনাশক জলে হাত ধুয়ে স্কুলে ঢুকছে। জোনা কিয়ে হয়তো আবার যাচ্ছেন তাকপইমা গ্রামে।
এ তো গেল আফ্রিকার ইবোলার কথা। কিন্তু তাতে আমাদের কী? আমাদের কি আদৌ এই অভিজ্ঞতায় মন দেওয়ার প্রয়োজন আছে?
আছে বোধ হয়। প্রথমত, এ দেশেও ঐতিহ্য আর রীতির নাম করে নানান অসুখ সম্পর্কে ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। তা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। ক’দিন আগেই এক রিপোর্ট বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ডায়ারিয়া এবং নিউমোনিয়ার মতো অসুখ সম্পর্কে স্রেফ না জানা আর ভুল জানার ফলে ভারতে বহু শিশু মারা যায়। আজও। এমন নজির অনেক। কিন্তু ইবোলার কাহিনি দেখিয়ে দেয়, এই বাধা অনতিক্রম্য নয়। যদি মানুষকে বোঝানো যায় যে কিছু ঠিকঠাক ব্যবস্থা নিলে অসুখটাকে বাগে আনা যাবে, তা হলে পুরনো ধারণা ও মানসিক বাধা পেরিয়ে তাঁরা পরামর্শ মেনে চলবেন। যে ধারণা এমনিতে ভাল, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে সেটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যেমন, যে সংহতিবোধ প্রাচীন সমাজের একটা বড় সম্পদ, সেটাই আবার গোড়ার দিকে ইবোলা রোগীকে আলাদা করতে না দিয়ে, কোয়ারান্টাইন-এ বাধা দিয়ে সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু সেই সমস্যার সঙ্গে লড়তে গিয়ে সংহতিবোধটাকে ছেড়ে দিলে চলবে না। সমাজকে নিয়ে, তার মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে হবে, বোঝাতে হবে, যাতে তাঁরা সচেতন হয়ে উঠতে পারেন আর নিজেদের লড়াইটা ঠিক ভাবে লড়তে পারেন।
সেই চেতনা আর তাগিদ তৈরি করতে পারলে কী অসাধ্য সাধন করা যায়, তার একটা দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে (জ্)বান্তামা গ্রাম। সিয়েরা লিওন-এর রাজধানী ফ্রিটাউন-এর উত্তরে এই গ্রামটি ইবোলা সামলাতে একটা পুরনো পরিত্যক্ত স্কুলবাড়িতে নিজেরাই তৈরি করে ফেলল স্বাস্থ্য কেন্দ্র, যাতে রোগীদের যতটা সম্ভব আলাদা করে রাখা যায়। শহর থেকে ওষুধ, নার্স যা সাহায্য পাওয়া যায়, তার সাহায্যে ইবোলা আটকাতে উদ্যোগী হলেন গ্রামের মানুষ। ব্যবস্থা করলেন, অন্তত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত যাতে আর ইবোলা ছড়াতে না পারে। লেগে থাকলে যে সামাজিক বাধা পার হওয়া যায়, তার প্রমাণ আমাদেরও জানা। এ দেশে পোলিয়ো ভ্যাকসিন নিয়ে নানান বাধা ছিল। সে বাধা দূর করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়েছে। কী করে? লেগে থেকে। লাগাতার প্রচার চালিয়ে। সচেতনতা বাড়িয়ে।
ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তও কম দামি নয়। ব্রিটিশ স্বাস্থ্যকর্মী উইলিয়ম পুলি সিয়েরা লিওন থেকে ইবোলা নিয়ে দেশে চলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে তিনি জীবনে ফেরেন এবং আবার ফিরে যান সিয়েরা লিওনে। তিনি মনে করেছেন মৃত্যুর চেয়ে ইবোলা-আক্রান্ত মানুষদের তাঁকে অনেক বেশি প্রয়োজন! তাঁর বক্তব্য, তিনি প্রথম বিশ্বের নাগরিক, তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষগুলোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া তাঁর দায়িত্ব। এবং তিনি জানেন যে তাঁর ইবোলা প্রতিরোধের ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গিয়েছে আর তাই তিনি একটু কম চিন্তা নিয়ে কাজ করতে পারবেন। তিন, তিনি বোঝাতে পারবেন ইবোলা কী, কেন, আর কী ভাবে আক্রান্ত মানুষদের উপকার করা যায়। এমন এক একটি দৃষ্টান্ত স্থানীয় মানুষকে, স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজসেবীদের কতটা প্রেরণা দেয়, কতটা মনের জোর দেয়!
আর একটা ব্যাপার হল, যখন একটা অসুখ হবে, তখন সেটাকে সামলাব এটা ভাবলে একেবারেই চলবে না। আজ সোয়াইন ফ্লু, উঠেপড়ে সামলাচ্ছি; কাল এনসেফ্যালাইটিস হবে, তার ব্যবস্থা করব নাভিশ্বাস তুলে; পরশু ম্যালেরিয়া, তখন কুইনাইনের সঙ্গে প্রচারও চালাব— হবে না। রোজ, প্রতিটা দিন স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে নজর দিতে হবে। শহরে এবং গ্রামে। একটা বিপদ হল, তখনকার মতো পুলটিস মেরে ক্ষতটাকে সামলে দিলাম, এতে কাজ হবে না। এক ভাবে লেগে থাকতে হবে। যখন অসুখটা কমবে, এমনকী থাকবে না, তখনও মানুষকে সচেতনতা বাড়ানোর কাজে লেগে থাকতে হবে। যখন ম্যালেরিয়া হবে না, তখনও মশারি টাঙিয়ে শুতে হবে, জল জমতে দেওয়া যাবে না। এই অভ্যেসগুলো একেবারে দাঁত মাজার মতোই অভ্যেস করতে হবে। পোলিয়ো কর্মসূচি আরও একটা দামি শিক্ষা দিয়েছে। যখন পোলিয়ো আক্রান্তের সংখ্যা কমে গিয়েছে তখনও কিন্তু কর্মসূচি জারি থেকেছে, নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কথ্য ভাষায় চেনা সুরের গান বাজিয়ে, বা মাইক নিয়ে অটোয় করে বলে বেড়ানোয়, আর নিরন্তর পরিশ্রম করে গিয়েছেন অসংখ্য ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মী। এবং মনে রাখতে হবে, রুটিন প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে, তাই শুধু পোলিয়ো তাড়ালে হবে না, অন্য ভ্যাকসিনেও জোর দেওয়া চাই।
আসলে চাই একটা সার্বিক সচেতনতা, সব দিক দিয়ে ভাল করার একটা প্রচেষ্টা, তার প্রস্তুতি। ভারতের মতো এমন একটা বিশাল জনসংখ্যার দেশে, যেখানে বহু জায়গাতেই স্বাস্থ্য পরিষেবা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায়, সেখানে যে কোনও দিন যে কোনও মহামারী শুরু হতে পারে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বরং হচ্ছে যে না, এতেই আশ্চর্য হতে হয়। কে বলতে পারে, কাল কলকাতায় এক জন ইবোলা-পজিটিভ রোগীর সন্ধান মিলবে না? তখন?