সরকারের মস্তিষ্কের বহর যাহাই হউক, ভারতীয়, এমনকী বাঙালি সমাজের হৃদয়ের মাপ এখনও নিতান্ত কম নহে। নোট বাতিল করিলে সাধারণ মানুষ যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হইবেন, তাহার কথা সরকার তলাইয়া ভাবিলে আরও অনেক সুগঠিত বিকল্প-ব্যবস্থা করিতে পারিত। ভাবে নাই। নির্ভাবনায় অজানিতের স্রোতে ঝাঁপ দিয়াছে। ফলে নানা অব্যবস্থা। বহু মানুষের বহু দুর্ভোগ, যে দুর্ভোগ প্রলম্বিত হইতেছে, হয়তো আরও হইবে। কিন্তু এই অব্যবস্থায় নাজেহাল মানুষের পাশে মানুষই আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। নানা স্থলে, নানা ভাবে। একটি দৃষ্টান্ত স্মরণীয়। পাহাড় দেখিতে আসিয়াছিলেন বিদেশি পর্যটক। কল্পনাও করিতে পারেন নাই ব্যাগস্থ হাজার-পাঁচশো রাতারাতি ‘অচল’ হইয়া যাইবে। তাঁহাদের পাশে ভারতীয় জনসমাজ সদাশয় সৌজন্যে উপস্থিত। নিজেরা অর্থ-সংগ্রহ করিয়া বিদেশিদের গাড়িতে চাপাইয়া নিকটবর্তী বড় শহরে পাঠাইয়া দিয়া মুশকিল যতটা সম্ভব আসান করিলেন। এমন অগণিত দৃষ্টান্ত রচিত হইয়াছে দেশ জুড়িয়া, গত কয়েক দিনে। বিশ্বাস ও সহযোগে সজীব সমাজের উপস্থিতি সহসা যেন রমরম করিয়া টের পাওয়া যাইতেছে। অবশ্য ইহা ভাবিবার কারণ নাই যে, সবাই যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মবীর কিংবা রাজা বলীর মতো দানবীর। ঘোলা জলে দুই-চারিখান লাভের মাছ শিকারের সুযোগ পাইলে তাহার সদ্ব্যবহার করিবেন, এমন নাগরিকের অভাব নাই। কেহ লোক দেখিয়া হাঁকিতেছেন ‘পাঁচশোয় চারশো’, কেহ খরিদ্দার না পাইয়া বাটা নামাইয়া বলিতেছেন, ‘হাজারে নয়শো।’ নিরুপায় লোক আসিতেছে। পরোপকারের কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ আমলে স্বদেশি সমাজের নির্মাণের জন্য উদ্যমী হইয়াছিলেন। পরাধীন ভারতবাসীকে খেয়াল করাইয়া দিয়াছিলেন, এ দেশে শাসক যায় আসে, সমাজ আপন গতিতেই চলে। সেই সমাজ শাসকের মুখের দিকে না তাকাইয়া মানুষের সহিত মানুষের সহযোগ বজায় রাখে। ইংরেজ শাসকের পরাধীন ভারতীয়দেরও এই নীতিই পালন করা উচিত, এমনই ছিল কবির বক্তব্য। সমাজ মানুষের জন্য, একের উৎসবে ও ব্যসনে অপরের পাশে থাকাই সেই সমাজের কাজ। সাম্প্রতিক নোটকাণ্ডে সমাজ এক ভাবে জাগিয়া উঠিয়াছে। কেবল কথায় নহে, কাজে। মুখে রাজা-উজির মারিবার স্বভাবধর্ম ভারতীয় সমাজ বহু দিন আত্মগত করিয়াছে। কিন্তু নোটপর্বে তাহারা সেই ধর্ম পালনেই সীমিত থাকে নাই, কাজে নামিয়াছে।
এক দিন এই পর্বের অবসান হইবে। বাজারও ক্রমে স্থিত হইবে। অর্থনীতিবিদরা তখন এই নোট-বাতিল কাণ্ডের চুলচেরা বিচার করিবেন। রাজনীতির কারবারিরা ভাবিবেন ভোটবাক্সে ইহার কী প্রভাব পড়িবে। আর সাধারণ মানুষের স্মৃতিচারণে এই দিনগুলির কথা নানা অনুষঙ্গে ভাসিবে। কিন্তু অনেকেরই মনে পড়িবে, এই কয় দিন বেশ মানুষের সহিত মানুষের সহযোগ ঘটিয়াছিল। কলিকাতার সুউচ্চ হর্ম্যের মানুষ পাড়ার মুদির সহিত হাসিয়া দুইটি কথা বলিয়াছিলেন। সাহেবসুবোদের সহিত ভাঙা-ইংরাজি বাঙালি গল্প করিয়াছিল। সামাজিক শীতলতা কয়েক দিনের জন্য কিছুটা মুছিয়াছিল। নোট, এবং নোটের সহিত কপাল কতটা পুড়িল, কালোবাজারি কতটা বিনষ্ট হইল, সেই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব মিলিবে কি না কে জানে! তবে এই উপলক্ষে সমাজ তো জাগিল। এইটুকুই বা কম কী?