ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সভাপতি মনের সব অন্ধকার দূর করে দিয়েছেন। কোনও কৌশল নেই, কোনও সংকোচ নেই, একটি ডুমুরপাতারও দরকার হয়নি, তাঁর শ্রীকণ্ঠে উৎসারিত হয়েছে অনাবিল জাতীয়তাবাদী নির্ঘোষ: ‘আমরা এখানে ক্ষমতায় থাকলে নিঃসন্দেহে যাদবপুরের ভিতরে ঢুকে দিল্লির মতো কলার ধরে ওই দেশবিরোধীদের বার করতাম— তা সে অধ্যাপক, কর্মচারী, ছাত্র, যে-ই হোক।’ একটি কথাতেই সহস্র সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর মনোবাসনা। তাঁর নয়, তাঁদের। ব্যক্তি নিমিত্তমাত্র, আমরা যা শুনলাম, তা দলের বাণী। বা, পরিবারের।
এই বাণীকে নিছক আস্ফালন বলে উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। আইআইটি-মাদ্রাজ-এ অম্বেডকর-পেরিয়ার স্টাডি সার্কল-এ নিষেধাজ্ঞা, পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের রাজসিংহাসনে শ্রীযুক্ত গজেন্দ্র চৌহানের প্রতিষ্ঠা, দিল্লির কিরোরি মল কলেজে ‘মুজফ্ফরনগর বাকি হ্যায়’ ছবির প্রদর্শনীতে হিংস্র হামলা, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলার মর্মান্তিক পরিণতি, জেএনইউ এবং কানহাইয়া কুমার এবং পাটিয়ালা হাউস— ‘আমরা এখানে ক্ষমতায় থাকলে’ কী কী হতে পারে, আমরা বিস্ফারিতনয়নে দেখে চলেছি। এই পরম্পরাকে এখনই ফ্যাসিবাদী আক্রমণ বলা উচিত কি না, বিশুদ্ধতার উপাসকরা তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সেই দ্বিধাকে একবাক্যে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর পরেও ফ্যাসিবাদ বিষয়ে যাঁদের মনে পবিত্র সংশয় থাকছে, সে সংশয় তাঁরা অনুগ্রহ করে নিজ দায়িত্বে রাখুন।
রাজ্য সভাপতি ও তাঁর সহনায়ক এবং সহনায়িকাদের ক্ষোভের কারণ বুঝতে খুব অসুবিধে হয় না। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ নামক বঁড়শিটিতে ঈষৎ পচে-যাওয়া জাতীয়তাবাদের চার লাগিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোলা জলে ছিপ ফেলে দু’চারটে মাছ ধরার অভিলাষ রাজনীতিকদের থাকতেই পারে। দেশের নানা এলাকায় এই পদ্ধতিতে মাছ-টাছ ভালই উঠেছে। কিন্তু যাদবপুর, দেখা গেল, কঠিন ঠাঁই। সেখানে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং প্রশাসকরা সবাই মিলে শান্ত ভাবে মানবশৃঙ্খল গড়ে উৎপাত প্রতিহত করেন, জল ঘোলা করার বিশেষ সুযোগই মেলে না। পুলিশ যে পুলিশ, তারাও ঠান্ডা মাথায় গোটা ব্যপারটা দিব্যি সামলে দেয়, এমনকী দু’চার জন দেশপ্রেমিক তাদের ব্যারিকেড টপকে দেশদ্রোহীদের দেখে নেওয়ার জন্য কয়েক পা এগিয়েও যেতে পারেন, প্রেসার কুকার থেকে কিছুটা জলীয় বাষ্প নিঃসরণের মতোই।
তবে ওঁদের সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছেন উপাচার্য স্বয়ং। নানা দিক থেকে প্রবল চাপের মুখে তিনি মাথা উঁচু রেখেছেন, আচার্য-রাজ্যপালের— না কি রাজ্যপাল-আচার্য— বডিলাইন চিঠি খেলেছেন ব্যাকরণ মেনে, এবং সাংবাদিকদের মাধ্যমে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীরা কে কী করেছে না করেছে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রশাসকরা বুঝে নেবেন, পুলিশে নালিশ করার কোনও প্রশ্ন নেই, তিনি কখনও ও জিনিস করেননি, ওটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরও স্বধর্ম নয়। পরধর্ম গ্রহণের পরিণাম এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছে, সে কথা আলাদা করে মনে করানোর কোনও দরকার ছিল না, উপাচার্য তা জানেন। এতটা আত্মমর্যাদাপূর্ণ এবং সুনিয়ন্ত্রিত আচরণের মোকাবিলা কী ভাবে করতে হয়, সে বিদ্যা হয়তো নাগপুর মডেলের পাঠশালায় শেখানো হয় না, তাই বিজেপি’র রাজ্য সভাপতির খেদোক্তি: ‘উপাচার্যের দম নেই।’ এতেই নির্ভুল বোঝা গেল, অন্তত এক জন উপাচার্যের দম আছে।
দম থাকা দরকার। এক জনের নয়, সকলের। দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তার পরিসরটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার এই অভিযান যাঁরা প্রতিহত করতে চান, তাঁদের সকলের। তা না হলে বিপদ বাড়বে। আজ যাঁরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন, তাঁরাও বিপন্ন হবেন। কাল না হোক, পরশু। জঙ্গি জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোটা এখন জরুরি।
আর তর্ক? নিশ্চয়ই। গণতন্ত্রে সেটাই তো আসল লড়াই। কোন আচরণে দেশদ্রোহ হয়, দেশদ্রোহ হলে কোন মহাভারত অথবা ভারতমাতা অশুদ্ধ হয়, জনসভায় দাঁড়িয়ে কোন স্লোগান দেওয়া উচিত, কোনটা নয়, আফজল গুরু থেকে নাথুরাম গডসে, আজাদ কাশ্মীরের দাবি থেকে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের হিটলার-বন্দনা, ২৬/১১-র মুম্বই থেকে ২০০২-এর গুজরাত— গণতন্ত্রে সব কিছু নিয়ে সমস্ত পরিসরে তুমুল তর্ক হওয়া উচিত।
সেই তর্কে সঙ্ঘ পরিবারের ধ্বজাধারীরা দলে দলে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু আগে কলারটা ছাড়তে হবে।