বদলের রূপকার। মান্না দে, সঙ্গে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ১৪.১০.৭৬। ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়।
জাতিস্মর ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেলেন কবীর সুমন। শুভেচ্ছা, সাক্ষাৎকার এখনও চলছে। স্বাভাবিক। কিন্তু কোলাহলটি বারণ হলে একটি প্রশ্ন ওঠাও সঙ্গত। সত্যিই কি বাংলা গান নিয়ে আমরা তেমন করে ভাবি?
মনে রাখার কথা বলছি না। সুরকার-গীতিকারদের নাম ভুলে গেলেও ‘অমুক সিনেমার অমুকের গলায় সেই গানটা’ ছকের শ্রুতি-স্মৃতি দিব্য অটুট। কিন্তু যে ভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্য, বাঙালির চিত্রকলা, নাটক, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে সিনেমাও, বাংলা গানের ক্ষেত্রে তেমন হয়েছে কি?
যদি তথাকথিত আধুনিক বাংলা গান ধরি তা হলে উত্তর: না। তথাকথিত বললাম এই জন্য যে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানের বাইরে সিনেমার গান এবং বেসিক গানের ধারাটাকেই সচরাচর আধুনিক বাংলা গান বলাটা আমাদের অভ্যেস। হয়তো অভ্যস্ত আলস্যেই আমরা কোনও দিন ভাবিনি, আমাদেরই নির্দিষ্ট করে দেওয়া এই ধারাটার উৎপত্তি কোথায়, কী ভাবে তার বিকাশ, কোনখানে তার ব্যর্থতা।
তার একটা বড় কারণ ওই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মানসিকতাটা। আসলে যে আবহমান বাংলা গানের ধারাতেই রবীন্দ্রসংগীত এবং তার পরবর্তী আধুনিক গান ধারা-বাহিক, রবীন্দ্রসংগীতকে একটা আলাদা অভিজাত ক্লাস হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার মোহে সে কথা আমরা তলিয়ে ভাবার অবকাশই পাইনি। অথচ রবীন্দ্রনাথই ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে এক বার লিখেছিলেন, ‘আমার আধুনিক গানে রাগ-তালের উল্লেখ নেই বলে আক্ষেপ করেছিস।’
আমাদের সংগীতচিন্তায়, অতএব, আধুনিক বাংলা গান নেই। স্মৃতির জাবর কাটায় আছে, রোম্যান্টিক প্রেমবিলাসে আছে, রিমেকেও আছে। কিন্তু চিন্তায় নেই। আধুনিক বাংলা গান বাঙালি সমাজের কোন শ্রেণি থেকে জন্ম নিয়েছে, তার উপভোগও বা কোন শ্রেণিতে কী ভাবে সীমাবদ্ধ, সে সব নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা অবশ্য হয়, কিন্তু সে তো সমাজতত্ত্বের এলাকা। ঠিক যেমন বাংলা সাহিত্যে কোন সময়ের কোন সমাজ কী ভাবে প্রতিফলিত হল সেই আলোচনা সাহিত্যের ‘সাময়িক’ মূল্যের বিচার, তার পরেও থেকে যায় তার পরমমূল্য নিরূপণের দাবি, গানের ক্ষেত্রেও তেমনই। আমাদের গানের ইতিহাসনিষ্ঠ ও যুক্তিনিষ্ঠ কোনও বিশুদ্ধ শিল্পবিচার আজও আমাদের অধরা।
কথাটা অবশ্য বাঙালির সামগ্রিক সংগীতচিন্তা সম্পর্কেই খাটে। প্রায় চব্বিশ বছর আগে নিজের সংগীতব্যক্তিত্বের প্রথম আত্মপ্রকাশের আগে ‘সংগীতচর্চা’ পত্রিকায় মানব মিত্র ছদ্মনামে এই আকালের কথা লিখেছিলেন কবীর সুমন, ‘আধুনিক সাহিত্যের কথা, আধুনিক নাটকের কথা, আধুনিক চিত্রকলার কথা ভাবতে গিয়ে তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি যে মনের পরিচয় দেয়, আধুনিক সংগীত সম্পর্কে তো বটেই, এমনকী তামাম সংগীত সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে সেই মনটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’ কথাটা বড় বেদনার মতো সত্যি।
অথচ আমাদের চোখের সামনে ছিল রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা, তাঁর সঙ্গে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতর্ক, দিলীপকুমার রায়ের অসামান্য রচনাগুলি। আধুনিক গানের সমালোচনা যে সুর, কথা আর স্রষ্টার মনের জটিল এক বিপ্রকর্ষের সন্ধান সে কথা আমরা মনেই রাখিনি।
রাখিনি বলেই, ক্রমে আমাদের তথাকথিত সংগীত সমালোচনাও আলাদা আলাদা খোপে জরাসন্ধের কারাগারের মতো দম আটকে রইল। ধ্রুপদী সংগীতের সমালোচনায় সুরের ব্যাকরণে আমাদের চিন্তা আটকে রইল, একদা যেমন সাহিত্যের বিচার হত অলংকারশাস্ত্রের প্রয়োগে। রবীন্দ্রসংগীতের মতো কয়েকটি ব্যক্তিচিহ্নিত গান-ধারায় মূলত কথার কবিতায় আমাদের মন পড়ে রইল। আর ওই যে আধুনিক গান, তার সমালোচনা বয়ে গেল এক পরম কুয়াশাময় ‘ভেগোলজি’র ধারায়। অর্থাৎ, অমুকের গানের নিবেদনটি সুন্দর, প্রমিত উচ্চারণের নিবিড় লাবণ্যে উপস্থাপনের পরিশীলিত কুশলতায়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ধারাবাহিকতা থেকে ছিঁড়ে ছোট্ট ছোট্ট শ্রেণি-পরিভাষার ছকের বিপদটা আসলে ভদ্রসমাজের ভয়ের পরিচায়ক। রবীন্দ্রসংগীত নিয়েই আমাদের সমালোচকরা এই বিভাজনের বিপদটা ঘটিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। অথচ, সংগীতচিন্তা-রই ‘সংগীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে সতর্ক করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘এতদিন আমাদের ভদ্রসমাজ গানকে ভয় করিয়া আসিতেছিল। তার কারণ, যা সকলের জিনিস, ভোগী তাকে বাঁধ দিয়া আপনার করাতেই তার স্রোত মরিয়াছে, সে দূষিত হইয়াছে। ঘরের বদ্ধ বাতাস যদি বিকৃত হয় তবে দরজা জানালা খুলিয়া দিয়া বাহিরের বাতাসের সঙ্গে তার যোগসাধন করা চাই। ইহাতে ভয় করিবার কারণ নাই, কেননা ইহাতে বাড়িটাকে হারানো হয় না। আজকালকার দেশাভিমানীরা ঐ ভুল করেন।’
ইদানীং বেশ কিছু অনুষ্ঠানে ধ্রুপদী, লোকগান, রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদ, বাংলা সিনেমার গান, রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক গান, নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী বাংলা গান সবে মিলে যে সদর্থে আধুনিক বাংলা গানের ধারা তাকে বোঝা এবং বোঝানোর চেষ্টা করছেন কবীর সুমন। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা গানের নানা দিক নিয়ে লিখে আসছেন সুধীর চক্রবর্তী। দু’একটি হলেও আধুনিক বাংলা গানের বিশ্লেষণ নিয়ে সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু সে সবের প্রভাব অতি সামান্য। মোটের উপর বাঙালির গান-চর্চা আসলে গান-গল্প। এক দিকে সেলেব্রিটি শিল্পীদের অন্দরমহলের গসিপ, আর এক দিকে নবীন শিল্পীদের গানের চরম দায়সারা বিবরণসর্বস্ব আলোচনা এবং সমালোচনা এখন বাঙালির সংগীতচিন্তার সম্বল।
মান্না দে-র মৃত্যুর পরে আজ তাঁর প্রথম জন্মদিনে একটা না-পাওয়ার কথা বার বার মনে হয়। তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছরে গলা চূড়ান্ত ব্যর্থ হবে জেনেও মান্না দে-র কাছে বার বার সেই বহু শোনা গানগুলোই আবার আবার শুনতে চেয়েছি আমরা। শুনতে চেয়েছি তাঁর মুখে অন্য বিশিষ্ট শিল্পীদের গল্প। অথচ কোন বিবর্তনে তিনি নিজেকে বার বার বদলেছেন, বদলে দিয়েছেন আধুনিক বাংলা গানকেও সেই একান্ত ভাবে সংগীতের কথাগুলি বলার জন্য তাঁকে ডাকিনি। অতি সম্প্রতি ‘সুরের সূর্য কৃষ্ণচন্দ্র’ নামে কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে নিয়ে তাঁর যে বছর চল্লিশের পুরনো লেখাটি বই হয়ে বেরল সেটাতেও দেখা যাচ্ছে সংগীতের চেয়ে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র প্রিয় তরকারি আর গোবরবাবুর কুস্তির গল্পই বেশি। কী করবেন মান্নাবাবু? পাঠক যা চায়!
সুতরাং, সেই ট্র্যাডিশন। জাতিস্মর-এর আরজে মহামায়া বাংলা গান নিয়ে লড়াই করে। বসের মুখের ওপর বলে ওঠে নজরুল ইসলামও আমার, রূপম ইসলামও আমার। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কী জাদু বাংলা গান গোছের এই প্রেম আমাদের আবিষ্ট করে। এ ভাবে গানকে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের সালাম। কিন্তু শুধু আ মরি বাংলা গান বললেই তো হবে না। গভীর, বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণে আমাদের সংগীতচিন্তায় তার যথার্থ প্রতিষ্ঠাও তো চাই।
নইলে আধুনিক বাংলা গানের জাতিস্মরণ হবে কী করে?
‘আধুনিক সাহিত্যের কথা, আধুনিক নাটকের কথা, আধুনিক চিত্রকলার
কথা ভাবতে গিয়ে তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি যে মনের পরিচয় দেয়,
আধুনিক সংগীত সম্পর্কে তো বটেই, এমনকী তামাম সংগীত সম্পর্কে
ভাবতে গিয়ে সেই মনটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার, প্রোডাকশন