মশালমিছিল। অভিজিত্ রায় হত্যার প্রতিবাদ, ঢাকা, ২৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এএফপি।
অভিজিত্ রায়ের হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ এখনও স্তম্ভিত। আমেরিকাপ্রবাসী অভিজিতের আজীবন বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, আর সেই ক্যাম্পাসেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামি আততায়ীদের হাতে পরিকল্পিত ভাবে নিহত হলেন তিনি। বিদেশে গবেষণা করতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়াশোনা করেছিলেন অভিজিত্। সেই বুয়েট ক্যাম্পাসও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরেই।
এই মুহূর্তে সামাজিক মিডিয়া-সহ পুরো বাংলা কমিউনিটি ব্লগমণ্ডল ফেটে পড়ছে প্রতিবাদে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের নানা শহরে, দেশের বাইরে লন্ডন, টরন্টো, নিউইয়র্ক, বার্লিন, সিডনিতে মানববন্ধন থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিবাদ সমাবেশ হয়ে গিয়েছে এই কয়েক দিনে। অনলাইন আর অফলাইনের প্রতিবাদে বারবার হ্যাশট্যাগে উঠে এসেছে ‘জ সুই অভিজিত্’ (Je suis Avijit, আমিই অভিজিত্)। তদন্ত ও বিচারের পাশাপাশি এসেছে মুক্তচিন্তার অনুসারীদের নিরাপত্তার দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছে সেক্টর কম্যান্ডার্স ফোরাম ও আরও অনেকে। উশকানিদাতা এক জঙ্গি গ্রেফতারও হয়েছে ইতিমধ্যে।
মুক্তচিন্তার গতিকে স্তব্ধ করতে লাগাতার আক্রমণের ফলে দীর্ঘ মৃত্যুমছিলে সাম্প্রতিকতম সংযোজন অভিজিত্। কিন্তু এ কি শুধু মৃত্যুরই মিছিল? মুক্তচিন্তার বিপরীতে, লেখনীর জবাব পাল্টা লেখনী দিয়ে দিতে ব্যর্থ পশ্চাত্পদ চিন্তার নৈতিক পরাজয়কেও চিহ্নিত করে এই হত্যা। যে চিন্তা, ভাবমূর্তি বা অনুভূতির নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহিংসতার আশ্রয় নিতে হয়, যুক্তিবাদী শান্তিপ্রিয় চিন্তাবিদদের কলম চিরতরে বন্ধ করে দিতে হয়, সে চিন্তা বা ভাবধারা যে কার্যত অচল এবং বাতিল, সেটাও প্রমাণ করে এই হত্যাকাণ্ড। অভিজিতের নিজেরই একটি উক্তি মনে করা যেতে পারে, ‘ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।’
অভিজিত্ রায়দের কেন মরতে হয়, বোঝা কঠিন নয়। যে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি লিখতেন, মহাবিশ্ব আর অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে, ধর্ম ও কুসংস্কারের অসারতা নিয়ে, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন নিয়ে, সেখানে শুধু একটি ধর্ম নয়, সকল ধর্মের অসহিষ্ণুতার প্রতি তাঁর আক্রমণ সমান ছিল। শুধু নিজে লিখে বা নিজে ভেবেই তিনি দায় সারেননি, যদিও শুধু অতটুকু করলেও তা কোনও অর্থেই কম করা হত না। তিনি জানতেন, সাংগঠনিক উদ্যোগ, সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন, সমমনা মানুষদের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্ব কতখানি। এবং সেই সঙ্গে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনার পরিসর তৈরির গুরুত্বও। বিভিন্ন সাংগঠনিক উদ্যোগের অংশ ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে ইন্টারনেটে ‘মুক্তমনা’ নামে একটি গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে সে সময়ের সর্ববৃহত্ আলোচনার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন তিনি। ২০০৯ সালে যখন বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭২ এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন শুরু হল, তখন বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)-এ বিচারপ্রার্থী অন্যান্য সব ব্লগ ও সংগঠনের পাশাপাশি সক্রিয় হয়ে ইঠেছিলেন অভিজিত্ আর তাঁর ব্লগ প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তমনা’। ব্লগার রাজীব হত্যার পর, নাস্তিকতার অপরাধে চার ব্লগার গ্রেফতারের পর সম্মিলিত ভাবে এই বাংলা ব্লগগুলি তখন দ্বিধাহীন নির্ভীক অবস্থান নিয়েছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে। অবস্থান নিয়েছিল সরকারের ইসলামপন্থী তোষণনীতির বিরুদ্ধে। সেটা এমনই এক সময় যখন এমনকী প্রগতিশীল মানুষরাও অনেকে ইসলামপন্থীদের ভয়ে মুখ খোলেননি। অভিজিত্কে জানতে, এবং তাঁর হত্যার কারণটি বুঝতে তাঁর সাংগঠনিক সত্তাটিকে মনে রাখা দরকার।
রাষ্ট্রের রাজনীতিতে আমরা বিভিন্ন দল ও আদর্শের প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। কেউ একে ব্যাখ্যা করেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে, কেউ করেন পুঁজির আধিপত্যের দ্বন্দ্ব হিসেবে। কেউ করেন ‘সব-আছে’ আর ‘সব-হারা’-র দ্বন্দ্ব হিসেবে। এগুলোর পাশাপাশি আরও একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে, যুক্তিবাদী বিশ্বদৃষ্টির সঙ্গে অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণতার দ্বন্দ্ব। তাত্ত্বিকরা বলবেন, এই দ্বন্দ্বও আসলে পূর্বোক্ত দ্বন্দ্বগুলিরই পরোক্ষ ফল বা লক্ষণমাত্র। হতেই পারে। কিন্তু এও মনে হয় যে এই শেষোক্ত দ্বন্দ্বটিও অতি বিশিষ্ট, প্রবল ভাবে বিরোধাত্মক, যা বার বার রীতিমতো অস্তিত্ব-সংকটের দ্যোতক হয়ে উঠতে পারে।
এই বিরোধাত্মক যুদ্ধেরও আর সব যুদ্ধের মতোই শহিদ আছে, আততায়ীও আছে। এবং পক্ষগুলোর মৌলিক ধরনটাই এমন যে সেখানে শহিদদের সবাই শুধু প্রথম দলেই, আর আততায়ীরা অন্য দলে। যেখানে প্রথম দল বিশ্বাস করে লেখা, লেখনী, বাকশক্তি, ক্যামেরা, আর দ্বিতীয় দল তাদের আধিপত্য বিস্তার করে অস্ত্র, সেখানে মৃতদের সবাই যে প্রথম দলেই থাকবে, তা আর বিচিত্র কী! আমরা জানি, বদ্ধ চিন্তার হাতে নিপীড়িতদের মিছিলে ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে আছেন ব্রুনো, কোপারনিকাস, গ্যালিলিয়োরা। কিন্তু অনেকেই মনে রাখি না, বাংলাদেশেও সেই তালিকা কিন্তু কম দীর্ঘ নয়। জন্মসময় জুড়ে মুক্তচিন্তার অধিকারের জন্য প্রাণ দিয়েছেন ১৯৭১-এর শহিদ বুদ্ধিজীবীরা। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাণ দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ ইউনূস, এম তাহের, এ কে এম শফিউল ইসলাম, জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুক, জগত্জ্যোতি তালুকদার, জাফর মুন্সী। অন্য দিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন জীবননাশের হুমকি। জঙ্গি মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান, হুমকির শিকার হয়েছেন আহমদ শরীফ। দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন। তালিকাটি দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না অভিজিত্ রায় একক নন, অভিজিত্ রায়রা প্রত্যেকেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদীদের কাছে কত বড় ভয়। ভয় জাগান বলেই তাঁদের প্রাণ দিতে হয়।
এই মৃত্যুযজ্ঞ কেবল প্রতিহিংসাপরায়ণ জঙ্গিরাই চালাচ্ছে না, এতে অংশ নিয়েছেন বহু মানুষ, অনেকগুলি দশক ধরে। ইসলামি পাকিস্তানের বিপরীতে সেকুলার স্বশাসিত বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ হল, সে যুদ্ধে পরাজয়ের ঠিক আগে পাক-বাহিনী ও তাদের তাঁবেদার ইসলামপন্থীরা এক মরণকামড় দিয়ে গেল। যে দেশটি স্বাধীন হতে যাচ্ছে, সে দেশটিতে সেকুলার মুক্তচিন্তার নেতৃত্ব যাঁরা দিতে পারবেন, সেই সব লেখক-কবি-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীকে তালিকা করে হত্যা করা হল। ১৯৭২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আর ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া হল, কিন্তু সে অবস্থান স্বাধীনতার চার বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তানপন্থী পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংশোধন করে পরিবর্তন করা হল। এর পর সামরিক সরকারের আমলে দেখা গেল আর এক দফা সংশোধন। ঘোষিত হল ইসলামই রাষ্ট্রধর্ম। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকে না, তবুও বাংলাদেশ নামের সেকুলার রাষ্ট্রটির উপর একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে আরোপ করতে হয়েছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদশের্র চাপে। আর এই গোটা সময়টা জুড়ে রাজনীতির নামে দেশব্যাপী লক্ষাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হল সরকারি ও বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায়, ধর্মভিত্তিক এক অসম শিক্ষাব্যবস্থার ডালপালাও বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হল সারা দেশব্যাপী। অথচ স্বাধীনতার জন্য যে দেশ এত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে, এত বড় মূল্য ধরে দিয়েছে, সে দেশটির তো কথা ছিল তার সবটুকু শক্তি দিয়ে সেকুলার মুক্তচিন্তার পরিবেশ গড়ে তোলারই। সেটা হল না। বিভিন্ন সরকারের আমলে রাষ্ট্র ও প্রচলিত রাজনীতির বিনিয়োগ হল ইতিহাসের ঠিক উল্টো পথটিতেই।
২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায় (পঞ্চম সংশোধনী মামলায়) কিন্তু সুযোগ তৈরি হয়েছিল সংবিধানকে সেই ১৯৭২-এর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার। এক দিন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে দলটি, সেই আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন সরকার কিন্তু সেই সুযোগ গ্রহণ করল না। বরং উল্টে এই আমলেই দেখা গেল, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে অসহনশীল একটি ধারাকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমমর্যাদা দেওয়া হল। অন্য দিকে, সংবিধানে ব্লাসফেমির কোনও বিধান না থাকলেও তথ্য প্রযুক্তি আইন (২০০৬)-এ ৫৭ ধারায় যা বলা হল, তা কার্যত ব্লাসফেমি বা ধর্মবিরুদ্ধতার শাস্তিমূলক আইনই বটে। এই বিধানমতে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হলে তার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড কিংবা এক কোটি টাকা জরিমানা, কিংবা দুই-ই। এই আইনের জোরেই চার ব্লগারকে হয়রানিমূলক ভাবে গ্রেফতার করা হল ২০১৩ সালে। নিতান্তই ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি আর চিন্তাপদ্ধতি-নির্ভর এই ‘ধর্মানুভূতি’-র মানদণ্ড নিয়ে ক্রিস্টোফার হিচেন্স সংশয় জানিয়েছিলেন, ধর্মানুভূতিতে ‘আঘাত’-এর সীমারেখা কে নির্ধারণ করবে? পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের মধ্যযুগীয় প্রয়োগ দেখার পর হিচেন্সের প্রশ্নের তাত্পর্য বুঝতে অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার পড়ে না।
অভিজিত্রা মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন। তাঁদের মৃত্যু পরোয়ানাও এই ভাবেই জারি হয়ে চলেছে। এই ধারার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদেরই ভাবতে হবে, কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সেই ভবিষ্যত্ স্থির করে দেবে। তবে আমরা যারা অভিজিত্ রায়ের সঙ্গে এক সময় এক সঙ্গে হেঁটেছি, তারা একটা কথা স্পষ্ট ভাবে জানাতে চাই: এই হত্যাকাণ্ড মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনটিকে সাময়িক ভাবে স্তম্ভিত করলেও স্থবির করতে পারবে না। বরং তা সমমনা মানুষদের সংকল্পকেই আরও দৃঢ় করবে। ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব’ ঠিক যেমন লিখে গিয়েছিলেন লেখক ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা, মুক্তিযুদ্ধের মুক্তমনা শহিদ জাহির রায়হান।
ইংল্যান্ডে আইনের শিক্ষক