প্রণব মুখোপাধ্যায়।
একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশের প্রায় সব কয়টি গুরুত্বপূর্ণ পদে যিনি কখনও না কখনও অভিষিক্ত হইয়াছেন, ‘কৃতী’ বাঙালি বলিলে তাঁহার পরিচয় নেহাত অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নামটি বাঙালির নিকট আক্ষরিক ভাবে ‘অনন্য’। ভবিষ্যৎ তাঁহাকে লইয়া বিস্তর আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা করিবে। করিবার সঙ্গত কারণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু যে কথাটি মানিতেই হইবে, তাহা হইল— ১৯৪৭-উত্তর বাঙালি জাতি যে সুদক্ষ সুকৌশলী রাজনীতিক তৈরি করিতে পারে, সেই দাবি তুলিয়া ধরিবার জন্য ভবিষ্যতেও এই নামটিই কিন্তু প্রথম সারিতে উচ্চারিত হইবে। প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই প্রাজ্ঞ কৌশল-বেত্তা, যিনি প্রধানমন্ত্রী না হইয়াও এক দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় ক্ষমতাশালী ছিলেন। দুই বার মাত্র নির্বাচনে লড়িয়াও ১৯৬৯ থেকে টানা চার দশক সংসদে আসীন ছিলেন। কোনও কালে জননেতা না হইয়াও জন-আন্দোলনের হালহদিশ নিখুঁত ভাবে জানিতেন। কেবল পশ্চিমবঙ্গে কেন, সমগ্র ভারতের রাজনীতি-জগতেই তাঁহার সহিত এক সমে উচ্চারিত হইবার মতো নামের সন্ধান মেলা কঠিন।
কৌশলী যিনি, তাঁহার আরও একটি গুণ থাকিতে হয়— প্রয়োজনে নিজেকে ছাপাইয়া যাইবার ক্ষমতা। এই বিষয়েও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নিকট ভারতীয় রাজনীতি-জগৎ শিখিতে পারে। ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও তিনি যে পরিস্থিতিতে পড়িতেন, তাহার মধ্যে নিজের সবটুকু মন ও শৃঙ্খলাবোধ দিয়া কাজ করিতে পারিতেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ না হইবার অভিজ্ঞতা তাঁহার জীবনে আসিয়াছে। ইন্দিরা গাঁধীর মর্মান্তিক বিদায়ের পরবর্তী কাহিনি সুবিদিত। আবার ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সফল সনিয়া গাঁধী যখন প্রণববাবুর রাজনৈতিক জ্যেষ্ঠতা উপেক্ষা করিয়া মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করিয়াছিলেন, নিশ্চয়ই জ্যেষ্ঠ-র হৃদয়বেদনা যথেষ্ট সজোর হইয়াছিল। তাহা সত্ত্বেও মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভায় প্রণববাবু সম্পূর্ণ আত্মনিবেশের সহিত কাজ করিয়াছেন, প্রধান নেতার নেতৃত্ব মানিয়া তাঁহাকে অভিভাবকের মতো দিগ্দর্শন দিয়াছেন। দলের নিকট, এবং সর্বোপরি, মানুষের নিকট সত্যকারের দায়বদ্ধতা থাকিলেই এই নিঃস্পৃহতা এবং কর্মনিমগ্নতা সম্ভব। তাঁহার শেষ বয়সের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদর দফতরে আমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইবার বিতর্কিত সিদ্ধান্তটির কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। সেই ঘটনায় দেশজোড়া ছিছিক্কার উঠিয়াছিল, কংগ্রেস প্রকাশ্যেই অখুশি হইয়াছিল, কিন্তু তিনি নিজের ভাবনায় অটল ছিলেন। দেশের শাসক দলের অঙ্গ হিসাবে যে সঙ্ঘের সহিত দেশবাসীর নিত্য ওঠাবসা, তাহাদের অস্পৃশ্য না করিয়া বরং তাহাদের শিবিরে গিয়া ভারতের বহুত্ববাদ ও বহুসংস্কৃতিবাদের স্পষ্টোচ্চারণ— তাৎপর্যপূর্ণ বইকি।
ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ তাঁহার মজ্জাগত উত্তরাধিকার। প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই ‘বৃহৎ’ ভারতীয় রাজনীতির ঐতিহ্য বহন করিতে গৌরব বোধ করিতেন, যাহা বড় মুখ করিয়া বলে: বৈচিত্র ও বিভিন্নতা এই দেশের সম্পদ, দুর্বলতা নহে। তিনি মনে করিতেন, গণতন্ত্র নিজের জোরেই তাহার সকল দুর্বলতা কাটাইয়া উঠিবে, কিন্তু মনে রাখিতে হইবে গণতন্ত্র কেবল সংখ্যার জোর নহে। শেষ দিকে তাঁহার প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় এই কথাগুলি ফিরিয়া ফিরিয়া আসিত। মেধাবী ছাত্র, প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, অক্লান্ত পাঠক— এই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি যে একঘেয়েমির ঝুঁকি মানিয়াও এ হেন পুনরুচ্চারণ করিয়া যাইতেন, তাহা নিশ্চয় অকারণ ছিল না। হয়তো জানিতেন যে, যে ধারার রাজনীতি তিনি বহন করিতেছেন তাহা দেশে আজ দুর্লভ সামগ্রীতে পরিণত হইবার উপক্রম। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে ছাপাইয়া তাঁহার রাজনীতির এই বিচক্ষণতা ও স্পষ্টতাই ইতিহাস মনে রাখিবে।