নড়ে বসতে গিয়েই কাতরে উঠলেন শিবুদা। পিঠের ব্যথাটা কয়েক দিন যাবৎ একেবারে পে়ড়ে ফেলেছিল। আজই বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে। আড্ডায় এসেছেন, আর কথায় কথায় তপেশকে ধমক দিচ্ছেন।
‘‘আপনি তো শুনবেন না, কিন্তু হোমিয়োপ্যাথিতে এই ব্যথার ভাল ওষুধ ছিল।’’ তপেশ বলল। মায়ের জন্য প্রতি মাসে এক দিন এক ডাক্তারের চেম্বারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হয় তপেশকে। সকাল থেকে রাত অবধি অপেক্ষা না করলে নাকি সেই ডাক্তারবাবুর দেখা মেলে না।
‘‘তুই থাম’’, ফের ধমক দিলেন শিবুদা। ‘‘তোকে অনেক বার বলেছি, ভূত ভগবান জ্যোতিষ আর হোমিয়োপ্যাথি, এই চারটে কুসংস্কারে আমি বিশ্বাস করি না।’’
‘‘আপনি বিশ্বাস না করলেই হল?’’ তপেশও তেরিয়া। ‘‘হোমিয়োপ্যাথিতে কত লোকের কত জটিল রোগ সারছে, জানেন? সবাই কি বোকা যে ফল না হলেও চিকিৎসা চালিয়ে যাবে?’’
‘‘তপেশ কিন্তু কথাটা নেহাত ভুল বলছে না, শিবুদা।’’ শিশিরও যোগ দেয়। ‘‘আমি মানি না ঠিকই, কিন্তু জ্যোতিষের আংটি পরে ভাগ্য ফিরে গিয়েছে, এ রকম লোক আপনি চেনেন না? বড়লোকদের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখবেন, কতগুলো আংটি পরে এক এক জন।’’
‘‘তোর কী মত?’’ সূর্যের দিকে তাকান শিবুদা। সূর্য নির্বিকার ঘাড় নাড়ে, অর্থাৎ মত দিয়ে সে বেঘোরে মারা প়ড়তে নারাজ।
একটু নড়েচড়ে বসেন শিবুদা। কোনও ভাবেই সুবিধা হচ্ছে না, পিঠের ব্যথাটা জ্বালাচ্ছে। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘‘জ্যোতিষের কথায় পরে আসছি, আগে হোমিয়োপ্যাথি়টা সেরে নিই। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল হেল্থ অ্যান্ড মেডিক্যাল কাউন্সিল হোমিয়োপ্যাথির চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর ১৮০০ গবেষণাপত্র নিয়ে সিস্টেম্যাটিক রিভিউ করে, এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানায়, ব্যাপারটা নিতান্তই ভাঁওতা। রোগ সারানোর ক্ষমতা হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের নেই। যেটুকু সারে, তা নিতান্তই প্লাসেবো এফেক্ট। মানে, তোকে ওষুধ বলে চিনির বড়ি খাইয়ে দিলেও যদি তুই ভাবিস ওষুধ খাচ্ছিস, তা হলেও অনেক রোগ সেরে যায়।’’
‘‘এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে, শিবুদা।’’ শিশির আপত্তি না করে পারে না।
‘‘হচ্ছে না।’’ শিবুদার সটান উত্তর। ‘‘যেটা হচ্ছে, তার নাম কনফার্মেশন বায়াস। ভেঙে বলি, শোন। মানুষের মন এক বিচিত্র বস্তু। মন যাতে বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাসের পক্ষেই প্রমাণ খুঁজে বে়ড়ায়। ধর, ছাতা নিয়ে না বেরোলেই বৃষ্টি হয়, এই বিশ্বাসটা তো রীতিমতো প্রমাণের ভিত্তিতেই আছে, তাই না? এ রকম কত দিন হয়েছে বল, যে তুই ছাতা নিয়ে বেরোসনি, আর ধুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফিরেছিস? কিন্তু, ভেবে দেখ, এ রকমও কত দিন হয়েছে যে তুই ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিস, আর তার পর বৃষ্টি এসেছে; অথবা, ছাতা নিয়ে বেরোসনি, বৃষ্টিও হয়নি; বা, ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিস কিন্তু বৃষ্টি হয়নি? তোর মন সেই দিনগুলোর কথা মনে রাখে না, কারণ সেই দিনগুলো মনের বিশ্বাসের সঙ্গে ম্যাচ করে না।
‘‘বিজ্ঞানের সঙ্গে কুসংস্কারের এখানেই আসল ফারাক। বিজ্ঞানে কোনও তত্ত্ব ঠিক কি না, তা যাচাই করার পথ হল, কোন কোন ভাবে তত্ত্বটা ভুল হতে পারে, তা পরীক্ষা করে দেখা। কোনও ভাবেই যদি তাকে ভুল প্রমাণ না করা যায়, তবেই সেটা ঠিক। আর, আমাদের মন সারা ক্ষণ শুধু মনের তত্ত্বটাকে ঠিক প্রতিপন্ন করার জন্য প্রমাণ খোঁজে।
‘‘হোমিয়োপ্যাথির গল্পটাও ঠিক তাই। তপেশের মতো যারা হোমিয়োপ্যাথিতে বিশ্বাসী, তারা শুধু খেয়াল রাখে, হোমিয়োপ্যাথিতে কার কোন রোগ সারল। কত জনের যে সারল না, সেই খোঁজ রাখে না। জ্যোতিষেও তেমন— কত লোকের হাত যে পাথর বয়ে বয়ে হন্যে হয়ে গেল, কিন্তু ভাগ্য ফিরল না এক চুলও, জ্যোতিষে বিশ্বাসীরা সেই হিসেবই রাখে না। কাজেই, তোদের বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র দাম নেই।’’ শিবুদা থামলেন।
‘‘আমার বৌও, বুঝলেন তো, যে দিনগুলোয় আমি ভেজা তোয়ালে বিছানায় ফেলে রাখি, শুধু সে দিনগুলোর কথা মনে রাখে।’’ শিশির বলে।
‘‘তোর তো ভাগ্যি ভাল যে বৌ শুধু গালি দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছে। কনফার্মেশন বায়াসের ধাক্কায় কত বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, শুনলে আঁতকে উঠবি।’’ মুচকি হাসেন শিবুদা। ‘‘সেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বৌয়ের কথা ভাব, যে প্রতি দিন বরের জামায় অন্য মেয়ের চুল খুঁজত। পরকীয়ার হাতেগরম প্রমাণ। কোনও দিন একটা চুলও না খুঁজে পেয়ে শেষে খেপে গিয়ে বরকে বলেছিল, লজ্জা করে না, নিজের বৌ থাকতে একটা টেকো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছ!’’
সবাই হেসে ওঠে। শিবুদা বলেন, ‘‘হাসির কথা নয় হে। যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ বলছে যে তোর বিশ্বাসটা ভুল, কিন্তু তার পরও তুই সেই বিশ্বাস আঁকড়ে আছিস আর প্রমাণগুলোকে পাত্তা দিচ্ছিস না, বরং সেই প্রমাণগুলোকে নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে মানানসই করে তোলার মতো যুক্তি খাড়া করছিস— মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় এই ব্যাপারটা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এবং, সবচেয়ে মারাত্মক কথা হল, সেই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কনফার্মেশন বায়াসের থেকে কেউ মুক্ত নয়। এমনকি, বিজ্ঞানও নয়। কিন্তু, প্রশ্ন হল, কেন? দুনিয়াশুদ্ধ লোক বুঝতে পারছে যে একটা কথা ভুল, তবু তুই সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকবি কেন? বা, তোর মন সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকবে কেন? কেন তোর মন বেছে বেছে সেই কথাগুলোই মনে রাখবে, যাতে তোর ধারণাটা সত্যি প্রমাণিত হয়? কেন তোর ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্যটুকুই খুঁজবে, অথবা পরমহংসের মতো অন্য, বিপরীতমুখী তথ্যের জল সরিয়ে শুধু নিজের ধারণার সঙ্গে মানানসই তথ্যের দুধটুকু খেয়ে নেবে? যে কোনও তথ্যকে নিজের ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে সেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বৌটির মতো?’’
সবাই চুপ। পিঠের ব্যথা ভুলে শিবুদা যে অন্য প্রসঙ্গে গিয়েছেন, এবং তাঁর মেজাজটাও ঠিক হয়েছে, গোপালও টের পেয়েছে। চুপচাপ চায়ের কাপ নামিয়ে দিয়ে গেল। শিবুদা চায়ে চুমুক দিলেন। শিশিরের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে খানিক আপন মনেই বললেন, ‘‘এমআইটি-র জার্নাল অব কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সেস-এ একটা পেপার বেরিয়েছিল। কনফার্মেশন বায়াস কোথা থেকে আসে, জানার জন্য ২০০৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ডেমোক্র্যাট জন কেরির কট্টর সমর্থকদের জোগাড় করে আনা হয়েছিল। একটা এমআরআই যন্ত্র তাদের মগজের গতিবিধি মাপছিল। দেখা গেল, পছন্দের প্রার্থী সম্বন্ধে অপছন্দের কথা শুনলে মগজের সেই অংশটা সক্রিয় হয়ে উঠছে, যা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপছন্দের প্রার্থীর ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা ঘটছে না মোটেও। অর্থাৎ, পছন্দের প্রার্থী সম্বন্ধে অপছন্দের কথা শুনলে মাথায় যেটা হচ্ছে, মনস্তত্ত্ববিদরা তাকে বলেন কগনিটিভ ডিসোন্যান্স— মানসিক অস্বস্তি। আর, জানিসই তো, মন এক বিচিত্র যন্ত্র। এই অস্বস্তিটা দূর করার জন্য মন নিজে থেকেই একটা গল্প বানিয়ে নেয়, যাতে অপছন্দের কথাগুলো আর থাকে না। মনও নিজের তৈরি করা গল্প নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকে।’’
‘‘তার মানে, আপনি বলতে চান, আমার মন যেটা শুনতে চায়, যা দেখতে চায়, শুধু সেটাই দেখে?’’ মাথা চুলকে প্রশ্ন করে সূর্য।
‘‘বলতে চাই না, সেটাই বলছি।’’ ‘দেয়া নেয়া’-র কমল মিত্তিরের সুরে উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘এই যে ঘরে ঘরে শাশুড়ি-বৌয়ের ঝগড়া, কেন বল দিকি? দু’জনই খালি পরস্পরের খারাপ দিকগুলো দেখে বলে। শাশুড়ির শুধু চোখে পড়ে বৌমা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে— সে যে অফিস থেকে ফিরে রাত সাড়ে বারোটা অবধি সংসারের জোয়াল ঠেলে, সেটা মনেই থাকে না। বৌমা শুধু দেেখ, শাশুড়ি তার নামে পাড়া বেড়িয়ে নিন্দে করে। শাশুড়ির গুণগুলো চোখে পড়ে না। দোষ মনের। মন দেখতে চায় না বলেই চোখে পড়ে না। একে তো মন শুধু নিজের পক্ষে প্রমাণ খোঁজে। তার ওপর, বাস্তবের কোনও জিনিসই একেবারে সাদা-কালো নয়। ফলে, শাশুড়ি আর বৌ, দু’জনেই ভাল-মন্দে মানুষ। নিজের পক্ষে প্রমাণ খুঁজতে মনের আরও সুবিধা।
‘‘শাশুড়ি-বৌকেও বাদ দে। শেয়ার বাজারের কথা ভাব। সেখানে মস্ত সব ফান্ড ম্যানেজাররা একটা শেয়ার বেচছে, পর ক্ষণেই অন্য শেয়ার কিনছে। কেন? তারা জানে, যেটা বেচছে, সেটার দাম পড়বে, আর যেটা কিনছে, সেটা লাভ দেবে। কিন্তু, যেটা বেচছে, সেটা কিনছে কে? আর যেটা কিনছে, সেটা বেচছে কে? তারাও তো শেয়ার বাজারেই করেকম্মে খায়। একটা শেয়ার সম্বন্ধে যে বেচছে, আর যে কিনছে, দু’জনের কাছে কার্যত সমান তথ্য রয়েছে। আসল ফারাকটা হল মনে, বুঝলি। দু’জনের মনে সেই শেয়ার সম্বন্ধে দু’রকম ধারণা আছে, আর তাই যে তথ্যগুলো দু’জনের কাছেই আছে, তার মানে দু’জনের কাছে সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নে, এ বার উঠি, অনেক বকেছি।’’ শিবুদা উঠে পড়েন।
আর তখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে। শিবুদার হাতে ছাতা নেই। ‘‘আরও বেরোন ছাতা ছাড়া! বলেছিলুম না, ছাতা নিয়ে না বেরোলেই বৃষ্টি হয়?’’ চিমটি কাটে তপেশ।