হেপাটাইটিস ভাইরাস। শিল্পীর কল্পনায়। ছবি: আইস্টক
মানুষের স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করার অন্যতম অসুখের নাম হেপাটাইটিস বা যকৃতের প্রদাহজনিত অসুখ। কয়েকটি অন্য কারণ ছাড়া হেপাটাইটিস হয় মূলত যকৃত বা লিভারে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে। হেপাটাইটিস-এ, বি, সি, ডি এবং ই— এই পাঁচটি ভাইরাস চিহ্নিত করা গিয়েছে। হেপাটাইটিস-এ এবং ই সংক্রমিত হয় দূষিত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস-বি, সি এবং ডি সংক্রমিত হয় রক্তের মাধ্যমে। যকৃতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রক্তের লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল শেষ হলে তার অন্তর্গত হলুদ রঙের বিলিরুবিন-কে দেহ থেকে নিষ্কাশিত করা। হেপাটাইটিসের ফলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ার জন্য রক্তে বিলিরুবিন-এর পরিমাণ বেড়ে দেহ হলদেটে হয়ে যায়।
হেপাটাইটিস মানবসভ্যতাকে আদিকাল থেকে বিপর্যস্ত করে এসেছে। অনেকে বলেন হেপাটাইটিস-এর উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় তিন হাজার বছর আগে সুমেরীয় সভ্যতায়। সেখানে পোড়ামাটির ফলকে পাওয়া গিয়েছে জন্ডিস-এর বর্ণনা। সুমেরীয়রা মনে করতেন আহাজু নামে এক শয়তানের আক্রমণই এই অসুখের কারণ। আধুনিক চিকিৎসার জনক হিপোক্রেটিসই প্রথম ৪০০ খ্রিস্টপূর্বে হেপাটাইটিসের নিখুঁত বর্ণনা দেন। খাদ্য হিসেবে তাঁর নিদান ছিল মধু আর জল। মধ্যযুগে আবার এই অসুখটিকে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হত। রোগীকে ‘অপবিত্র’ বলে বর্জন করার নিদান দিতেন ধর্মযাজকেরা। হেপাটাইটিসের বড় শিকার সেনাবাহিনীর সদস্যেরা। ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে হেপাটাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেপাটাইটিসের বলি হন এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত হেপাটাইটিসের কারণ বিজ্ঞানের কাছে ছিল এক প্রহেলিকা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এর কারণগুলি বোঝা সম্ভব হয়। ১৯৬৩ সালে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আবিষ্কার করলেন জেনেটিক বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ। তিনি বিভিন্ন অসুখের জিনগত সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করছিলেন। কাকতালীয় ভাবে এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীর রক্ত পরীক্ষার সূত্রে আবিষ্কার করলেন হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসকে। তাই নাম দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্টিজেন। দু’বছর পরে মাইক্রোবায়োলজিস্ট মিলম্যান-এর সঙ্গে আবিষ্কার করলেন হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন। হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-ডি, হেপাটাইটিস-সি এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস আবিষ্কৃত হল যথাক্রমে ১৯৭০, ১৯৭৭, ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে। ব্লুমবার্গ তাঁর আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে সবথেকে বিপজ্জনক হেপাটাইটিস-বি এবং সি। কারণ, এই দু’ধরনের ভাইরাস থেকে অসুখ হলে চরম অবস্থা বেশ বিপজ্জনক হয়। আবার এই দু’টি ভাইরাস থেকে নিরাময়-অযোগ্য ক্রনিক হেপাটাইটিসও হতে পারে। আবার ক্রনিক হেপাটাইটিস থেকে হতে পারে লিভার সিরোসিস, লিভারের ক্যানসার। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী ওই বছরে সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত প্রায় ২৫ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের মধ্যে লিভারের সিরোসিস এবং ক্যানসারে মারা গিয়েছেন আট লক্ষ সাতাশি হাজার জন। আর ২০১৬ সালে হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে প্রায় চার লক্ষ।
ব্লুমবার্গের আবিষ্কারের পরে হেপাটাইটিস বি-এর টিকাকে আমেরিকার নিয়ামক সংস্থা ইউএসএফডিএ প্রথম ক্যানসার-প্রতিরোধী টিকা বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। হেপাটাইটিস-ডি অবস্থান করে হেপাটাইটিস বি-এর সঙ্গেই। হেপাটাইটিস বি-এর টিকা নিলে তাতে হেপাটাইটিস বি-এর সঙ্গে সঙ্গে হেপাটাইটিস ডি-এরও প্রতিরোধ করা যায়। হেপাটাইটিস-বি, সি এবং ডি সংক্রমিত হয় অশুদ্ধ ইঞ্জেকশন সুচ ব্যবহার, সংক্রামিত রক্ত গ্রহণ, সেলুনে ও উল্কি আঁকার সময়ে শুদ্ধতার অভাব— ইত্যাদির মাধ্যমে। সংক্রমিত মায়ের থেকে শিশুর দেহেও এই ভাইরাসগুলি সংক্রমিত হয়।
হেপাটাইটিসের চিকিৎসার ব্যাপারে আশার আলো দেখিয়েছে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধেরা। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি-এর ক্ষেত্রে ভাইরাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করতে পারলেও অসুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর হেপাটাইটিস সি-এর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নতুন ওষুধ আবিষ্কারের ফলে তা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। যদিও এই সব চিকিৎসাই ব্যয়বহুল। দূষিত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে সংক্রামিত হেপাটাইটিস-এ এবং ই এমনিতে বিশ্রামে নিরাময় হয়ে যায়। তবে সামান্য সংখ্যক ক্ষেত্রে হঠাৎ বেড়ে গিয়ে বা ফালমিনেন্ট হেপাটাইটিস হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। হেপাটাইটিস-ই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। হেপাটাইটিস-এ নিবারণের জন্য আছে টিকা। তবে প্রয়োজন শুদ্ধ জল, ভাল নিকাশি ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা।
মনে রাখতে হবে সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে রক্তের মাধ্যমে ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত মানুষের অধিকাংশই জানেন না যে তাঁরা এই অসুখে আক্রান্ত। ল্যানসেট জার্নালের এপ্রিল ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী লিভারের ক্যানসারে আক্রান্তদের মধ্যে ক্রনিক হেপাটাইটিস-বি এবং সি-তে আক্রান্ত ছিলেন যথাক্রমে শতকরা ৪২.১ এবং শতকরা ৩১ ভাগ। অথচ রোগীরা নিজেরাই তা জানতেন না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, হেপাটাইটিস বি-তে সম্ভাব্য আক্রান্তদের শতকরা মাত্র ১০.৫ ভাগ নিজেদের সংক্রমণের কথা জানেন আর রোগ চিহ্নিত হয়েছে মানুষের শতকরা মাত্র ১৬.৭ ভাগ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকেন। এর কারণ, হেপাটাইটিস নির্ণয়, টিকাকরণ বা চিকিৎসার ব্যয়বহুলতা এবং অবশ্যই সচেতনতার অভাব ।
‘হেপাটাইটিস দিবস’ পালনের ভাবনার জনক আমাদের পাশের রাজ্য ওড়িশার চিকিৎসক এসপি সিংহ-এর। ব্লুমবার্গ তাঁর আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ করেছেন। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার উদ্যোগে চিকিৎসক ব্লুমবার্গের জন্মদিন ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ হেপাটাইটিস ভাইরাস মুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য ২০৩০ সালকে ধার্য করা করেছে। এর জন্য আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন। তাই এ বছর ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০১৯’-এর স্লোগান, ‘Invest in eliminating Hepatitis’।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী