প্রতীকী ছবি।
অ্যান্ড্রয়েড নামক প্রযুক্তিটি তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে; ক্রিকেটের ক্রিজে সচিন তেন্ডুলকরের উপস্থিতি অমোঘ; বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ কতখানি, আইপিসিসি তাহা সদ্য জানাইয়াছে। হোয়াইট হাউস তখনও কোনও কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দেখে নাই। লিবিয়ায় মুয়াম্মর গদ্দাফি আর মিশরে হোসনি মোবারক রাজত্ব করিতেছেন। এক দশকেরও বেশি সময় আগেকার কথা। তখনই শেষ বার গোটা দুনিয়ার সব তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনীতি বাড়িতেছিল। পরবর্তী এক দশক ২০০৭ সালের মহামন্দার ধাক্কা দেখিয়াছে, ইউরোপের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিয়াছে, তেলের দামে ধস দেখিয়াছে, চিনের ধাক্কা খাইবার আশঙ্কায় ভুগিয়াছে। ২০১৮ সাল ছুঁইয়া ফের সুসংবাদ আসিল— আবার দুনিয়ার সব প্রধান দেশগুলির অর্থনীতি বৃদ্ধি পাইতেছে। দুনিয়ার সার্বিক বৃদ্ধির হার চার শতাংশের কাছাকাছি। কোনও এক অলৌকিক মহৌষধি বিশ্বকে রক্ষা করে নাই। ঘটনা হইল, এক একটি দেশ এক-এক পথে মন্দা হইতে নিস্তার পাইয়াছে। বিশ্ব জুড়িয়া বৃদ্ধিটি সুস্থায়ী হইবে কি না, সেই প্রশ্নও রহিয়াছে— বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, বৃদ্ধিটি এখনও মাত্র কয়েকটি দেশের উপর নির্ভরশীল। তবে, এই আর্থিক বৃদ্ধি যে সর্বজনীন হইবে না, তাহা এক প্রকার নিশ্চিত— শিক্ষিত, সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত, রাজনৈতিক সংযোগসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর বাহিরে তাহার সুফল কতখানি পৌঁছাইবে, সেই বিষয়ে সংশয় যথেষ্ট। কিন্তু, তাহা এই বৃদ্ধির দোষ নহে। গোটা বিশ্বেই আর্থিক বৈষম্য এবং অসমতা যে-ভাবে বাড়িয়াছে, তাহাতে ভিন্নতর ছবিতে উপনীত হওয়া কার্যত অসম্ভব।
কিন্তু, প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনীতি একই সঙ্গে বৃদ্ধির পথে হাঁটিতেছে, এই মুহূর্তটিকে উদ্যাপন করাই বিধেয়। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় একটি দেশের সহিত অপর দেশের অর্থনৈতিক যোগসূত্র এমনই গভীর যে একের অসুখ যেমন দ্রুত অন্য দেশে ছড়াইয়া যায়, তেমনই সমৃদ্ধিও কাঁটাতারের সীমান্তের তোয়াক্কা করে না। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অর্থ অধিকতর বৈদেশিক বাণিজ্য, অধিকতর উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান। গোটা বিশ্বই সেই সম্ভাবনার পথ চাহিয়া আছে। ভারতই যেমন। আগামী অর্থবর্ষে সাড়ে সাত শতাংশ হারে বাড়িতে হইলে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভর করিতেই হইবে।
তবে, এই মুহূর্তে অন্য একটি প্রশ্নও আছে— এমন সুখ টিকিবে তো? ফের কোনও ধাক্কায় দুনিয়ার অর্থনীতি গুটাইয়া যাইবে না তো? তাহার নিশ্চিত, এমনকী যথেষ্ট সম্ভাব্য উত্তর দিতে পারে, এমন সাধ্য কাহারও নাই। কিন্তু, সংকটের আঁচ হইতে যথাসম্ভব বাঁচিবার পন্থা কী, সেই উত্তর সন্ধান করা সম্ভব। এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্য দিকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিকে রাখিয়া তুলনা করিলেই স্পষ্ট হইবে, বৃদ্ধির হারের নিম্নগতি আর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সমীকরণটি সরলরৈখিক নহে, সর্বজনীনও নহে। একই সংকটের আঁচ স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় অনেক কম লাগিয়াছে। তাহার কারণ খুঁজিতে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নাই— সামাজিক সুরক্ষার স্তরভেদের দিকে তাকাইলেই চলিবে। যে রাষ্ট্র নাগরিকের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি মিটাইবার দায়িত্ব লয়, এবং ধনীদের হইতে অধিকতর কর আদায় করিয়া দরিদ্রদের জন্য ব্যবস্থা করে, সেখানে বড় ধাক্কাও অনেক সহনীয় ভাবে লাগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপরীতগামী। ‘ওবামাকেয়ার’-এর যে পরিণতি হইতেছে, তাহাতে স্পষ্ট, সাধারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আরও কমিবে। দুশ্চিন্তার কথা, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই এই প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী। অর্থনীতি যতক্ষণ অবধি ছন্দ মানিয়া চলে, ততক্ষণ তবুও সমস্যা নাই— কিন্তু, ধাক্কা লাগিলে সব এলোমেলো হইয়া যাওয়ার ঝুঁকিটি এই মডেলে বড় বেশি।