এক টিভি সাংবাদিক এবং এক কৌতুকশিল্পী রীতিমতো নাটক বাধালেন বিমানযাত্রার পথে। সাংবাদিক অন্যের প্রতি এক নাগাড়ে অভিযোগ ছোড়ার জন্য বিখ্যাত। তাঁকে সহযাত্রী পেয়ে কৌতুকশিল্পী সে ভাবেই তাঁর প্রতি এক তরফা প্রশ্ন করে গেলেন, উত্তরহীন সাংবাদিকের ভিডিয়ো দিলেন সমাজমাধ্যমে। কাজটা ভাল হল কি? এক দলের বক্তব্য, ব্যক্তিগত পরিসরে এ ভাবে জোর করে ঢুকে পড়া ভুল। অন্যেরা বলছেন, ঠিক হয়েছে। ওই টিভি সাংবাদিক এক বার তো টের পেলেন, চিৎকার করে অন্যের স্বর ডুবিয়ে দিলে তাঁর কেমন লাগে।
এই বিতর্ক চলবে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, তর্কের জমি ফিরে পেতে আজ কেন সভ্যতার সীমা ডিঙিয়ে, আইনের আগল ঠেলে এগোতে হচ্ছে? সেটা ঠাহর করতে হলে আমাদের হয়তো ফের একটু ভাবতে হবে, গণতান্ত্রিক রাজত্ব বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? অবহিত নাগরিকদের সাময়িক সংখ্যাগুরু অংশের জনপ্রতিনিধিরা সংসদের শাসক পক্ষ সামলাবেন। যে প্রতিনিধিরা ওই মরসুমের সংখ্যালঘু, তাঁরা অবহিত নজর রাখবেন বিরোধী আসনে বসে। সরকার ভুল করলেই বিরোধীরা যুক্তিতর্ক-সহ তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করে তার দিকে জনদৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। বিরোধীদের এ কাজে সাহায্য করবে বিচক্ষণ গণমাধ্যম। সংসদের বাইরে নানাবিধ মঞ্চে সুধীবৃন্দ বিতর্কের মাধ্যমে অবহিত আলোচনার সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখলে সাধারণ মানুষ সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকবেন।
প্রত্যেকটা পর্যায়ে অবহিত থাকার কথাটা অগ্রগণ্য, তাই এত নজরটান। এই সুপরিচিত চিত্রের দুটো উপেক্ষিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করুন। প্রথমত, সংখ্যাগুরুরা কেবল রাজনীতিতেই অস্থায়ী সংখ্যাগুরু তা নয়, খবর রাখার ক্ষেত্রেও অস্থায়ী। এই সে দিনও অধিকাংশ মানুষ বুঝত না যে পৃথিবীটা গোল। অধিকাংশের মনে বহু ভ্রান্তি বদ্ধমূল থাকে, ধীরে ধীরে ভুল ভাঙে। সংখ্যালঘুদের কাছেই সংখ্যাগুরুরা ক্রমশ শিক্ষালাভ করে। এই শিক্ষালাভের গতি বাড়ানো জরুরি। অথচ দিশেহারা লাগে। রকমারি মতের মধ্যে কোন মুনির কথা বরণীয়, কী করে বুঝবেন?
দেখুন, কোনও প্রবক্তাই একা কথা বলেন না। তরজার চাপান-উতোর নিবেদন করে বলেন, “এই নিন আমার বক্তব্য। এর চালচিত্রে আমার বিভিন্ন পূর্বপক্ষের প্রস্তাবও পাবেন, প্রস্তাবে প্রস্তাবে ভাঙা-গড়ার খেলাও পেয়ে যাবেন।” আপনি বিশেষ এক জন মুনিকে তো বরণ করবেন না। কোনও এক জনের জবানিতে যে ভাবে অতীতের তর্কগুলোর পরম্পরা মেনে সাজানো হয়েছে, তাকে বেছে নেবেন। এটা ব্যক্তি হিসেবে করতে গেলে বিপত্তি ঘটতে পারে। নিজেকে তরজার জায়গা রূপে চিনতে শেখা দরকার। আপনি এই নাটকে কেবল অভিনেতা নন। আপনি আস্ত একটি নাটমঞ্চ। সেই মঞ্চকে চিনতে চিনতেই অভিনেতা হিসেবে আপনার ক্রমবিকাশ।
‘কেজি থেকে পিজি’ অবধি আপনি শুনে এসেছেন, নিজের আখের গোছাও, পরীক্ষায় সফল হও। অথচ ব্যক্তির বিকাশ তো একক তালগাছের বেড়ে-ওঠা নয়। বুদ্ধির পাঞ্জা লড়তে শেখা। পাঞ্জার দ্বিপাক্ষিকতার স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করবে ছাত্র হিসেবে আপনার বিকাশের স্বাস্থ্য। এখানেই গণতান্ত্রিক আলোচনার দ্বিতীয় অবহেলিত বৈশিষ্ট্য। এক জন আলোচক নিজের বুদ্ধিতে একা-একা শান দিতে পারে না। দু’তিন জন মিলে তরজা জমে উঠলে তবে বুদ্ধি খুলবে।
সংস্কৃত ভাষার আমলের আলোচনাশাস্ত্রে নিয়ম ছিল, যে বক্তব্যের সঙ্গে আপনার লড়াই, সেই ‘পূর্বপক্ষ’কে প্রথমে নিজের জবানিতে পেশ করবেন। তার পর আপনার মত, যার নাম ‘সিদ্ধান্তপক্ষ’। যে মতের সঙ্গে পাঞ্জা, আগাগোড়াই সেটার চোখে চোখ রেখে এগোতে হবে। ন্যূনতম শ্রদ্ধা না থাকলে তো ওই লোকের সঙ্গে তরজায় নামতেনই না। এক বার নেমে মাঝপথে শ্রদ্ধা ফিরিয়ে নিতে যদি চেষ্টা করেন, তা হলে সবাই বুঝবে আপনার সাহস ফুরিয়ে গেল, আপনি চোখ রাঙিয়ে কথা ঘোরাতে চাইছেন, তর্কে পেরে উঠছেন না দেখে।
শ্রদ্ধা ‘আবশ্যিক’ বলতে কী বোঝায়? সঙ্গীর বক্তব্য মানতে আপনি বাধ্য? তা কেন হবে। ‘সঙ্গীর বক্তব্য’ তো একটা সোজা রেখামাত্র নয়; তিনিও তো আস্ত ছবিই এঁকেছেন। তাতে আপনার বক্তব্যের প্রতিমূর্তিটাকেও তিনি সাজিয়েছেন পূর্বপক্ষ রূপে। আদর্শ তরজায় দুই পক্ষ যে ভাবে ‘সিদ্ধান্তপক্ষে’ পৌঁছবেন তার পুরো পথক্রমটা যেন নাটকের রূপ নেবে। বিষয়টা নিয়ে চিন্তাশীল মানুষ কী ভাববেন, কোন যুক্তিতে ভাববেন, ধাপে ধাপে তার বিবর্তন ফুটিয়ে তুলবে ওই নাটক। এবং দ্বৈরথের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাপিয়ে দুই পক্ষই ক্রমশ নাটকের রসাস্বাদনের গভীরে প্রবেশ করবে।
এই রসের স্বাদ চিনতে শিখতে হয়। শিশুরা মিষ্টিকে ভালবাসতে শেখে, তেতোকে এড়ায়। নোনতায়-ঝালে মেশানো ব্যঞ্জনের রকমারি স্বাদের কদর বুঝতে দেরি করে। ওগুলো যে নাটকের জায়গা। নিজেকে ‘একক ব্যক্তি’ না ভেবে আমরা যত ক্ষণ না ‘নাটকের রঙ্গভূমি’ ভাবতে শিখছি, যত ক্ষণ না বিভিন্ন ভূমিকায় নেমে নাটক ব্যাপারটার রসকে চরম রস ভাবতে পারছি, তত ক্ষণ তরজায় সমকক্ষ নটরূপে যোগদান আমাদের অসাধ্য থেকে যাবে। এই ‘চিনতে পারা’-র শিক্ষাটা স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষায়তনের কাছে আমরা পাচ্ছি না। তাই সুশীল সমাজের মঞ্চে, নাটকের আখড়ায়, বন্ধুদের সান্নিধ্য থেকে তা আদায় করে নিতে হবে। নইলে যে পূর্ণাঙ্গ সাবালক হয়ে উঠতে পারব না।
মোটাসোটা শরীরের বিপদ আমরা বুঝতে শিখেছি। মনও কিন্তু নিজেকে একক বিকাশের জায়গা ভাবতে ভাবতে, কল্পিত একাকিত্বে হোঁতকা হয়ে যায়। সুকুমার রায়ের শিশুশিক্ষা পেয়েও। এটাতে প্রমাদ গনতে আমরা অনেকেই শিখিনি। ওই বিপদটাকে চিনতে পেরে, তার প্রতিষেধক খুঁজতে নিজের কল্পনাশক্তির আর রসাস্বাদনকে গুরুত্ব দেবেন যত বেশি নাগরিক, তত উন্নত হবে তাঁদের বিবেচনাশক্তি। সেই উন্নতির উপরেই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। কথাটা বুঝতে বড়ই দেরি করে ফেললাম যে। তাই কখনও সাংবাদিক একাই মঞ্চ দখল করতে চাইছেন, কখনও শিল্পী তাঁকে জোর করে নিজের মঞ্চে টেনে সংলাপ শুরু করতে চাইছেন। নাটক একটা তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা অলীক কুরঙ্গ। গণতন্ত্রের বিচিত্র রস তাতে কই?