প্রণব মুখোপাধ্যায়
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অন্যতম কর্মকর্তা মনমোহন বৈদ্য এ দেশের ‘বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ইন্টেলেকচুয়াল’দের এক হাত নিয়েছেন। আরএসএসের বিচারে তাঁদের মূল অপরাধ অবশ্যই এই যে, তাঁরা বামপন্থী। তবে অধুনা তাঁদের আর একটি অপরাধ হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় (ছবিতে) সঙ্ঘের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে নাগপুরে তাদের সদর দফতরে যেতে রাজি হয়ে ঠিক করেননি। এতেই আরএসএস নায়কের প্রবল ক্রোধ উৎপন্ন হয়েছে। সেটা অন্যায় নয়। আরএসএস যদি উত্তরোত্তর ভারতীয় সমাজ-রাজনীতির মূলস্রোতে স্বীকৃতি পেতে চায়, সেই বাসনাকে অস্বাভাবিক বলা চলে না কোনও মতেই। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে প্রধান অতিথি হিসেবে পেলে সেই বাসনা চরিতার্থ করার পথে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়া যাবে। এমন একটা শুভ কাজে বাদ সাধলে রাগ তো হবেই।
কিন্তু রাগটা প্রধানত বামপন্থীদের উপরে হল কেন? প্রণববাবুর নাগপুর যাত্রা নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরমহলেই তো বরং বেশি প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সঙ্ঘকর্তার বক্তব্য, কংগ্রেসের (কোনও কালেই) নিজস্ব কোনও ভাবনাচিন্তা নেই, তাই কমিউনিস্টরা যা বলে তারা সেটারই প্রতিধ্বনি করে, প্রণববাবুর নাগপুর যাত্রা নিয়ে কংগ্রেসের নেতাদের আপত্তিও ওই কমিউনিস্টদের কাছে মগজ বিকিয়ে দেওয়ার ফল। কমিউনিস্ট-বিদ্বেষের তাড়নায় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বোধ হয়। ঠিক যেমন বাড়াবাড়ি বামপন্থী আর কমিউনিস্ট, দুইয়ের বেমালুম সমীকরণটিও। অবশ্য মোদীর রাজত্বে সঙ্ঘের নায়ক বাড়াবাড়ি করলে ঠেকায় কে?
শ্রীযুক্ত বৈদ্যের প্রধান অভিযোগ, ‘কমিউনিস্ট’রা প্রণববাবুর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, কারণ তাঁরা ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করেন না, তাঁরা তত ক্ষণই অন্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে রাজি যত ক্ষণ অন্যেরা তাঁদের সঙ্গে সহমত। এই অভিযোগকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দূরস্থান, সহিষ্ণুতাও কমিউনিস্ট পার্টির আচরণে কোনও কালেই সুলভ ছিল না। ‘তর্কশীল ভারত’-এর পার্টিও মোটেই তার ব্যতিক্রম নয়। রাজ্যপাট থেকে শুরু করে প্রায় ঘটিবাটি অবধি চলে গিয়েছে, তবু আজও বিরুদ্ধ মত শুনলে বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক-আনা দু’আনার নায়কদের চোয়াল যে ভাবে শক্ত হয়ে যায়, তাতেই বোঝা যায়, অহঙ্কার নামক ব্যাধিটি তাঁদের একেবারে মজ্জাগত। সুতরাং আরএসএস কর্তার অভিযোগ সম্পূর্ণ অসার নয়।
এটাও অনস্বীকার্য যে, প্রণব মুখোপাধ্যায় কাদের ডাকে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কী বলবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁরই। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের ঠিক-ভুল বিচারের অধিকারও নিশ্চয়ই অন্যদের আছে। একই যুক্তিতে, প্রণববাবুর সমালোচকদের অভিমত আরএসএস (বা অন্য যে কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি) না-ই মানতে পারে, কিন্তু তাদের কথাই শেষ কথা হতে যাবে কেন? প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্নের টানাপড়েনই গণতন্ত্রের স্বধর্ম।
আরএসএসের ধর্ম বোধ করি আলাদা। শ্রীবৈদ্য, কিছুটা আলগোছেই, বলেছেন: এটা খুব দুর্ভাগ্যের কথা যে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো এক জন প্রবীণ নেতার সিদ্ধান্ত নিয়ে কংগ্রেসের অনেক জুনিয়র লোকজন প্রশ্ন তুলছেন; কই, আরএসএস-এর এক জন সদস্যও তো প্রশ্ন তোলেনি— প্রণববাবুকে কেন সঙ্ঘের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হল!
এই মন্তব্য শুনে গণতন্ত্র কিন্তু সটান ঘুরে দাঁড়াবে এবং শ্রীবৈদ্যের মুখের উপর বলবে, জুনিয়ররা কেন প্রবীণ নেতার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না? হতেই পারেন ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি, এবং ভারতীয় রাজনীতির দুনিয়ায় বয়োজ্যেষ্ঠদের এক জন, তাই বলে তাঁর আচরণ প্রশ্নাতীত হবে কেন? যে কোনও বিষয়ে যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করার অধিকার তো একটি প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকার। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক জনও সঙ্ঘের কর্তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি— কেন? গুরুজনেরা যা করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নেই বলে? প্রশ্ন না করার শিক্ষাই তাঁরা আগাগোড়া পেয়ে এসেছেন বলে? তাকে তো শিক্ষা বলে না, কী বলে সেটা রবীন্দ্রনাথ তোতাকাহিনীতেই জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সঙ্ঘ পরিবার কি তবে ওই পাখিপড়াকেই শিক্ষা বলে মনে করে? দুষ্টু লোকে বলে, তাদের শাখায় শাখায় যে পাঠ দেওয়া হয়, সেখানে নিজস্ব প্রশ্ন তোলার কোনও অধিকার ছাত্রছাত্রীদের নেই, গুরুমশাই বা দিদিমণি যা শেখান সেটাই শিখতে হয়, সেই গুরুবাক্যকেই নিজের মন কি বাত করে নিতে হয়। এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হতে সেই মন বুঝি প্রশ্ন তোলার সহজাত ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলে?
সেই জন্যেই বুঝি নরেন্দ্র মোদী কখনও সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, কেবল বক্তৃতা দেন, কারও কোনও প্রশ্নের জবাব দেন না, জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়েও নিজেই প্রশ্ন করেন, নিজেই তার উত্তর দেন, আর মাঝে মাঝে শ্রোতাদের দিয়ে সেই নিজের উত্তরটা সমস্বরে বলিয়ে নেন, পাঠশালার সর্দার-পড়ুয়ার ঢঙে?
সঙ্ঘ পরিবারের সন্তানরা, আর যা-ই হোক, তর্কশীল ভারতীয় নন।