এত রক্ত কেন? কলকাতায় এত হিংসা কেন?

এই কলকাতাই তো উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের শহর, এই কলকাতাই তো মেকলের ইংরেজি শিক্ষার শহর! প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষালকলকাতায় বসে কলকাতাকে দেখা আর কলকাতা থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী দিল্লিতে বসে কলকাতাকে দেখার মধ্যেও ফারাক থাকে। আমার পুত্র যখন দিল্লির স্কুলের ছাত্র তখন ক্রিকেট ম্যাচে কোনওদিন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যদি রান না করেই আউট হয়ে যেতেন তবে তার জন্যও বন্ধুরা ওকেই উপহাস করত। ‘বাঙালি দাদা কা কেয়া হো গ্যায়া!’ বাংলার যে কোনও ঘটনার এক আপ্লুত প্রভাব এসে পড়ে দিল্লির সর্বভারতীয় পটভূমিতে। সল্টলেক নির্বাচন নিয়ে যা হল তা মর্মান্তিক, দুঃখজনক এবং তার প্রভাবও ভয়াবহ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

আক্রান্ত সাংবাদিক অরিত্রিক ভট্টাচার্য।

Unknown to me the wounds of the famine of 1943, the barbarities of war, the horror of the communal riots of 1946 were impinging on my style and engraves themselves on it, till there came a time whenever I did, whether it was chiseling a piece of wood or burning metal with acid to create a gaping hole…bodying forth a single theme the figures of the deprived, the destitute and the abandoned converging on us from all directions.- Somnath Hore.


কলকাতায় বসে কলকাতাকে দেখা আর কলকাতা থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী দিল্লিতে বসে কলকাতাকে দেখার মধ্যেও ফারাক থাকে।
আমার পুত্র যখন দিল্লির স্কুলের ছাত্র তখন ক্রিকেট ম্যাচে কোনওদিন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যদি রান না করেই আউট হয়ে যেতেন তবে তার জন্যও বন্ধুরা ওকেই উপহাস করত। ‘বাঙালি দাদা কা কেয়া হো গ্যায়া!’
বাংলার যে কোনও ঘটনার এক আপ্লুত প্রভাব এসে পড়ে দিল্লির সর্বভারতীয় পটভূমিতে। সল্টলেক নির্বাচন নিয়ে যা হল তা মর্মান্তিক, দুঃখজনক এবং তার প্রভাবও ভয়াবহ। এ তো সৌরভের ক্যাচ ধরতে পারা বা না পারা অথবা সেঞ্চুরি করা বা না করার মতো বিষয় নয়! রাজনীতি অথবা নির্বাচন কোনও খেলা নয়।
সল্টলেকের নির্বাচনে যে ভাবে একসঙ্গে এত জনকে ধরে পেটানো হল তা ভয়াবহ। নিন্দনীয়। একসঙ্গে এত জন সাংবাদিককে পেটানোর ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে দেখলাম এই প্রথম। অন্তত ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে এই প্রথম।
বিশ্বায়নের অমোঘ গতিতে পৃথিবী এগোচ্ছে। আর্থিক সঙ্কট, মুদ্রাস্ফীতি, উদ্বাস্তু সমস্যা, গোটা দুনিয়াই এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, ভারতের মতো এত বড় একটা দেশেও সমস্যা কম নয়। গরু খেয়েছে এই সন্দেহে দাদরিতে ঘরে ঢুকে মানুষকে হত্যা করছে মানুষ, উত্তরপ্রদেশেও সাংবাদিকরা প্রহৃত, এমনকী নিহত হচ্ছেন। জাতপাতের সংঘাত, সাম্প্রদায়িক হিংসা— ভারতীয় রাজনীতির মেনুতে কোনও কিছুরই অভাব নেই!
কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের এ কী হল? এই কলকাতাই তো উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের শহর, এই কলকাতাই তো মেকলের ইংরেজি শিক্ষার শহর, এই কলকাতাই তো গোরা-বিনয় থেকে অমিত রায়-নিখিলেশের শহর!

Advertisement

পুলিশের সামনেই চলেছে শাসানি। — নিজস্ব চিত্র।

এত রক্ত কেন? কলকাতায় এত হিংসা কেন? শাসক দল ভোটে জেতার জন্য শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই রিগিং করে এমন নয়। সিপিএম যখন ক্ষমতায় ছিল তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী। বৈজ্ঞানিক রিগিং পদ্ধতি তো তখনকার সৃষ্ট শব্দ। তখন এক জন কনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি এবং পাতার পর পাতা লিখতাম পুলিশ এবং সিপিএমের ঠ্যাঙারে বাহিনীর ভোট-রণকৌশল-সন্ত্রাস। জ্যোতিবাবু তখন মুখ্যমন্ত্রী। আমি তখন ‘বর্তমান’ পত্রিকার কর্মী ছিলাম। আমরা লিখলে জ্যোতিবাবু বলতেন এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পুরো চিত্র নয়। আজ সিপিএম বিরোধী দল। সেই জঙ্গি বিরোধী নেত্রী ক্ষমতার কুর্সিতে। পুলিশ-ক্যাডার-সন্ত্রাস-রিগিং-বহিরাগত-বুথ ক্যাপচার, সবই কিন্তু আছে ঠিক আগেরই মতো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ও তাঁর দল কতটা দায়ী তা নিয়ে কলকাতা এখন তুলকালাম, মমতার টিম বলছে, এ সবই সিপিএম ও কতিপয় সংবাদমাধ্যমের ষড়যন্ত্র। বদনাম ও কুৎসা ছড়ানোর কৌশল।

Advertisement

এই বিতর্কটা জরুরি, কিন্তু অন্য একটি প্রশ্ন করব। যে-ই করে থাকুক না কেন এই ষড়যন্ত্রের ব্লু-প্রিন্ট, এই প্রশ্নটি কি করা যায় না যে, কেন এ ধরনের হিংসাত্মক কার্যকলাপ দমনে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে? ষড়যন্ত্র যদি সরকার বিরোধী হয়, যদি তা পূর্বপরিকল্পিত হয় তবে সেটিও দমন করা সরকারের কাজ। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের প্রকাশ্য জেহাদ ঘোষণা করা, মন্ত্রীদের প্রকাশ্য বিরোধিতাও কি সাংবিধানিক সঙ্কট ডেকে আনছে না রাজ্যে?

বুথে বহিরাগত দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রীতিকুমার সেন। সেই অপরাধের
৬৭ বছরের বৃদ্ধকে রাস্তায় ফেলে চলে বেধড়ক মারধর। সল্টলেকে। — নিজস্ব চিত্র

ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক হিংসা পশ্চিমবঙ্গে। জাতপাতের দাঙ্গা অথবা সাম্প্রদায়িক হিংসা বিহার ও উত্তরপ্রদেশে হয়তো বেশি, কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ হল ‘ফার্স্ট বয়’। লালকৃষ্ণ আডবাণী যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখনও গোয়েন্দা ব্যুরো আয়োজিত ডিজি সম্মেলনের রিপোর্টে এ কথা বলা হয়, আবার সুশীল শিন্ডে-চিদম্বরমের সময়েও সে কথাই বলা হয়। কেন এ হেন রাজনৈতিক হিংসা? নীরদ সি চৌধুরী লিখেছিলেন, বাঙালিরা আদতে শাক্ত। এমনকী, গাঁধী-সুভাষের বিরোধকেও তিনি বলেছেন বৈষ্ণব ও শাক্তের বিরোধ। বাঙালি ডিএনএ–তেই কি তবে হিংসা আছে?

হারবার্ট ছবির একটি দৃশ্য, দেওয়ালে মা কালী এবং চারু মজুমদারের ছবি ঝুলছে একই সঙ্গে। সম্প্রতি জনম মুখোপাধ্যায়ের বই Hungry Bengal: War, Famine and end of Empire পড়লাম। জনম টরেন্টোর Ryerson বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি বলছেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, কলকাতার দাঙ্গা, খাদ্যসঙ্কট, জাপানের আক্রমণ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা বাঙালি মননে যে গভীর প্রভাব ফেলেছে তা থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। অমর্ত্য সেন দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে লিখতে গিয়ে বাংলার দুর্ভিক্ষর বিশ্লেষণ করেন। তিনিও বলেছিলেন, বাঙালির অনাহার সে সময়ে শুধু খাদ্যসঙ্কট ছিল না, আসলে চাল কেনার আর্থিক ক্ষমতাও সে দিন বাঙালির ছিল না। সেই আর্থিক অক্ষমতা বাঙালির মননের গভীরে আজও মাকড়সার মতো জাল বিস্তার করে আছে। এই তো বেশ কিছু দিন কলকাতায় কাটিয়ে এলাম। বরং বলা ভাল, ৩০০ বছর নয়, ৫০০ বছরের প্রাচীন কলকাতার যমজ শহর হাওড়ায় কাটিয়ে এলাম।

যেখানে গিয়ে দেখলাম, কী কষ্টে কত সংগ্রামের মধ্যে আছে মানুষ। প্রত্যেকটি পরিবারেই বোধহয় গড়ে এক জন করে বেকার আছে। চাকরি নেই, চাকরির সুযোগ নেই, রাজনীতি করা, ভোটে রিগিং করাই কি তবে বাঙালির ‘স্টার্টস আপ’? হিংসাতেই কি ক্যাথারসিস? বাঙালির মুক্তি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement