করোনাভাইরাস লইয়া ব্যতিব্যস্ত হইয়াছে চিন। হইবারই কথা, ভাইরাস সংক্রমণ হইতে দেশে মৃত্যু ছাড়াইয়াছে আঠারো শত, আক্রান্তের সংখ্যা সত্তর হাজারেরও বেশি। যুগে যুগে নানা দেশে রোগ-অসুখ মড়কের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়াছে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তাহা প্রতিরোধে কতখানি সফল বা ব্যর্থ হইয়াছে সেই সাক্ষ্যপ্রমাণও বিরল নহে। কিন্তু তাহা সবই অতীতের কথা, একুশ শতকের চিন যেন করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করিয়া যুদ্ধে নামিয়াছে। যুদ্ধের চেহারাটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের, বলা যাইতে পারে অতিনিয়ন্ত্রণের। অকুস্থল উহান শহর কার্যত এক অবরুদ্ধ দুর্গ, প্রবেশ বা নির্গমনের জো নাই। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে, খাস রাজধানীতেও সরকার শত শত স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিকে দায়িত্ব দিয়াছে শক্ত হাতে নাগরিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের। আবাসনের বাসিন্দাদের প্রবেশ-বাহিরের অনুমতিপত্র, শহরে ঢোকা বন্ধ করিতে রেল স্টেশনেই যাত্রীদের আটকাইয়া দেওয়া, গ্রামের সীমান্তে যানবাহন জড়ো করিয়া ব্যারিকেড তৈরি, এই সমস্ত কিছুর অধীনে এখন জীবন কাটিতেছে অন্তত ৭৬ কোটি চিনা নাগরিকের।
অসুখ যখন মহামারি হইয়া ছড়াইয়া পড়ে, তাহা প্রতিরোধে সরকার বা প্রশাসনকে অনেক ক্ষেত্রে কঠোর হইতে হয় বটে। চিনের ক্ষেত্রে রোগটি ভাইরাস জনিত বলিয়াই অধিক সমস্যার, কারণ এক হইতে বহু মানুষে রোগ ছড়াইয়া পড়িতে শারীরিক নৈকট্যই যথেষ্ট। সেই কারণেই চিনে এত অনুশাসনের বাড়াবাড়ি। ইতিহাসবিদেরা বলিতেছেন, এই রূপ সমাজ-নিয়ন্ত্রণ বহু দশক পরে দেখা যাইতেছে, শেষ দেখা গিয়াছিল সম্ভবত মাও জে দংয়ের আমলে। জন-নিয়ন্ত্রণে চিনের বর্তমানে কমিউনিস্ট সরকারেরও খুব সুখ্যাতি আছে বলা যাইবে না, চুপ করাইয়া দিবার অভ্যাস তাহা একপ্রকার সংস্কৃতিতে পরিণত করিয়া ফেলিয়াছে। জানুয়ারি মাসেই করোনাভাইরাস বিষয়ে এক চিনা চিকিৎসক সতর্ক করিয়াছিলেন, প্রশাসন তাঁহার কথা উড়াইয়া দেয়, তাঁহার উপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে। সেই হতভাগ্য চিকিৎসকেরও প্রাণ নিয়াছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। দুই চিনা নাগরিক স্বেচ্ছা-সাংবাদিকের ভূমিকা লইয়া উহান শহরের পরিস্থিতি বিষয়ে আন্তর্জালে ভিডিয়ো দিয়াছিলেন, কিছু দিন হইল তাঁহাদের আর খোঁজ মিলিতেছে না। করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ঢাকাচাপা দিয়া রাখিতেও প্রশাসনের উদ্যোগের অভাব ছিল না, ইদানীং পরিস্থিতি লাগামছাড়া হইবার উপক্রম করিতে নাগরিকদের উপরে নিয়ন্ত্রণবিধি আছড়াইয়া পড়িয়াছে।
নিয়ন্ত্রণের অন্তঃস্থ শব্দটি ক্ষমতা। প্রশাসন যাহারই হাতে নিয়ন্ত্রণের দায়ভার তুলিয়া দিক, সঙ্কটকালেও ক্ষমতা প্রদর্শনের লোভ সংবরণ করা মুশকিল হইয়া পড়ে। সরকার-নিযুক্ত চিনা স্বেচ্ছাসেবী, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠিতেছে, তাঁহারা নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করিতে গিয়া প্রকারান্তরে দমন করিতেছেন। করোনাভাইরাস রুখিতে আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক চিনা সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হইয়াছে, এ-হেন জনরবও ছড়াইয়াছে বহির্বিশ্বে। আসল সত্য কী বা কতখানি, এই সরকারের নিকট হইতে তাহা উদ্ধার হইবে না, এমনই সন্দেহ। সঙ্কট তাই কেবল মহামারি প্রতিরোধের নহে, সুস্থ ভাবমূর্তি উদ্ধারেরও। কী উপায়ে চিনা সরকারের রাহুমুক্তি ঘটিবে, তাহাই দেখিবার।