অভিযান: রাজ্যসভার নির্বাচন নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে, নির্বাচন কমিশনের সামনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনেকেই হাজির। নয়াদিল্লি, ৮ অগস্ট। ছবি: পিটিআই।
রাজনীতিতে নাটকীয় মোড় কোনও অভিনব ঘটনা নয়। কারণ এখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। শত্রু-মিত্রের অবস্থানও দ্রুত পরিবর্তনশীল। কে কার সঙ্গে কোন অংকে ঘর বাঁধবে, তার উত্তর অনেক সময়ই সহজ বুদ্ধিতে মেলানো কঠিন। কিন্তু এমন রুদ্ধশ্বাস নাটক দেখার সুযোগ বড় একটা মেলে না। গুজরাতের রাজ্যসভা ভোটে আহমেদ পটেলের সৌজন্যে তা দেখা গেল।
কীভাবে কী হয়েছে, বিজেপি-র আশার ভাতে ছাই দিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী আহমেদ পটেল কেমন করে শেষ মুহূর্তে বাজিমাত করতে পেরেছেন সে-সব মোটামুটি সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল দেখিয়েছে সেই ফুটেজ— এক দীর্ঘদেহী কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ব্যালটটি শুধু নিজের দলের এজেন্টকেই নয়, বিজেপির এজেন্টকেও দেখাচ্ছেন। একই কাজ করেছিলেন তাঁর আরও এক দলীয় সতীর্থ। ওই বিধায়করা ঠিক কী করেছেন তার প্রতিটি পদক্ষেপ খতিয়ে দেখে নির্বাচন কমিশন তাঁদের দুটি ভোট বাতিল করার পরেই পরিস্থিতি আহমেদের পক্ষে মোড় নেয়।
রিগিং-জাল ভোট-ছাপ্পার দেশে জনপ্রতিনিধিরা এক দলের জামা গায়ে অন্যকে ভোট দেবেন, এ আর কী এমন! এটা তো তাঁদের ‘স্বীকৃত’ অধিকার। অতীতেও এমন ঘটনা বার বার ঘটেছে। এই পশ্চিমবঙ্গেও প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৯৩ সালের রাজ্যসভা ভোটে হিসেবের ৪৩টি ভোটের জায়গায় ৫০টি ভোট পান। একটি ভোট বাতিল হওয়ায় প্রণববাবুর প্রাপ্ত ভোট দাঁড়ায় ৪৯। তখন রাজ্যসভা ভোটের ব্যালট দলীয় এজেন্টকে দেখানোর নিয়ম ছিল না। সবটাই আপাতভাবে গোপন থাকত। তবু সবাই বুঝতে পারে, বামফ্রন্টের শিবির থেকে ভোট ভাঙিয়েই বাম প্রার্থী নীলোৎপল বসুকে বেশি ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন প্রণববাবু।
আর এক বার ২০০০ সালে কংগ্রেসের ঘরে বড় ভাঙন ধরিয়ে তৃণমূল প্রার্থী জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে রাজ্যসভায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হেরে যান কংগ্রেস প্রার্থী দেবপ্রসাদ (মিঠু) রায়। সেটি আরও চমকপ্রদ। মাত্র তিন জন বিধায়ক ছিলেন তৃণমূলের। ভোটের ফলে দেখা গেল, তৃণমূলের নিজের ৩টি ভোট, ‘বিক্ষুব্ধ’ কংগ্রস বিধায়কদের ১৫টি ভোট, বিজেপির একটি ভোট ছাড়াও কংগ্রেস শিবিরের অন্তত ২৫টি ভোট জয়ন্তবাবু টেনে নিয়েছেন। সে জয়ের পিছনে কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
আজ এই সব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার উদ্দেশ্য হল— মনে করিয়ে দেওয়া। সময় বদলায়। রাজনীতির কুশীলবেরা বদলান। খেলার বিধি বদলায় না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কোনও নির্দিষ্ট দলের টিকিটে জিতে আসার পরেও সুযোগ মতো সেই দলকে গুছিয়ে ল্যাং মারতে সিদ্ধপদ! আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
কে বলতে পারে, এই রাজ্যে এ-বারের রাজ্যসভা ভোটে সিপিএম প্রার্থী বিকাশ ভট্টাচার্যের প্রার্থী-পদ খারিজ না হয়ে গেলে কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্যের জয়ই বা কতটা মসৃণ হত?
বস্তুত আহমেদ পটেলও তো জিতেছেন অন্য কোনও দলের থেকে অন্তত একটি ভোট ভাঙিয়ে। সেই দল নীতীশ কুমারের জেডিইউ হোক, বা শরদ পওয়ারের এনসিপি। মূল ছবি একই। নিজের দল ছাড়াও অন্য দলের এক জন ভোট না দিলে আহমেদের জয়ের ঝুলি ভরত না।
এই মর্যাদার লড়াই জিততে বিজেপি স্বাভাবিক ভাবেই মরিয়া ছিল। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে শেষ মিনিট পর্যন্ত যে-ভাবে তারা আহমেদ পটেলের পরাজয় নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে, সেটা খুবই দৃষ্টিকটু।
ভোট ব্যাংক অটুট রাখতে কংগ্রেস কেন তাদের বিধায়কদের গুজরাত থেকে বেঙ্গালুরুর রিসর্টে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু কিসের ভয় বা হাতছানি এড়াতে ওই বিধায়কদের সরানো হয়েছিল, সেটাও তো প্রশ্ন। নচেৎ বিনা কারণে ৪৫ জন লোককে রাজ-আতিথ্যে রিসর্টে রেখে দেওয়ার বিলাসিতা করা হবে কেন? কেনই বা বেঙ্গালুরুর রিসর্টে কংগ্রেস বিধায়কদের দায়িত্বে থাকা কর্নাটকের মন্ত্রীর বাড়িতে ঠিক এই সময়টি বেছে নিয়েই আয়কর হানা হল, সে প্রশ্নও কি খুব অন্যায্য?
আসলে নীতি-গাছের শিকড় বড়ই দুর্বল। তাকে যে কোনও সময় অনায়াসে মুড়িয়ে দেওয়া যায়। সব দলের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। গণতন্ত্রের এই প্রহসন আমরা মেনে নিতে শিখেছি।
অথবা, গাছটিই হয়তো নেই আর! নইলে কংগ্রেসের দুই বিধায়কের ভোট যাতে বাতিল না হয়, সেজন্য বিজেপির প্রথম সারির মন্ত্রীরা সদলবল নির্বাচন কমিশনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন না। এখন ভিডিয়ো ক্যামেরার দৌলতে কোনও কিছু গোপন করার সুযোগ কম। এখানেও পরিষ্কার দেখা গিয়েছে, কংগ্রেসের ওই দুই বিধায়ক নিজেদের ভোট দিয়ে সেই ব্যালট কংগ্রেস ছাড়াও বিজেপির প্রতিনিধিকে দেখাচ্ছেন। যা আইনত করা যায় না। দেখানো যায় একমাত্র দলের এজেন্টকে। সব দেখে-বুঝেও গুজরাত বিধানসভায় বসে থাকা রিটার্নিং অফিসার কিন্তু প্রবল চাপের মুখে দুটি ভোট-বাতিলের সিদ্ধান্ত নিজের ক্ষমতাবলে ঘোষণা করতে পারেননি।
দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের রায় চেয়ে পাঠানোর পরে সেখানেও চাপের রাজনীতি! সাত-সাত জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কমিশনের দফতরে ছুটে গেলেন কেন? কী বোঝাতে? যা হয়েছে তা ঠিক? সারা দেশ টিভির পরদায় বার বার যে ফুটেজ দেখতে পাচ্ছে, অরুণ জেটলি, রবিশঙ্কর প্রসাদ, পীযূষ গয়ালরা সেটা দেখেননি, তা তো হতে পারে না। তবু সত্যিকে মিথ্যে প্রমাণের একটি অপপ্রয়াস জারি রইল মাঝরাত পর্যন্ত। টানাপড়েন মিটিয়ে ফল বেরোতে রাত দুটো। আশার কথা, নির্বাচন কমিশন টলেনি।
এ সব তো রাজনীতির খেলা। প্রশ্ন হল, রাজ্যসভা কি এই লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল? সংসদের উচ্চকক্ষে (আপার হাউস) সদস্য হওয়ার মাপকাঠি কি এমনই ছিল? নীতিহীনতার পৃষ্ঠপোষকতা?
ব্রিটেনের সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে আমাদের রীতি নিয়ম তৈরি হয়েছে। আপার হাউসের ধারণাও সেখান থেকেই। ১৯১৯ সালে মন্টেগু চেমসফোর্ড প্রথম উভয় কক্ষের কথা বলেন। যার সদস্য হবেন লর্ড, ব্যারন, বিশপের মতো মর্যাদাসম্পন্নরা।
ভারতে সংসদীয় ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরিতে মোতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১৯২৮ সালে উভয় কক্ষের প্রয়োজনীয়তা মেনে নেয়। ১৯৩৬ সালে কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি কমিটির রিপোর্টে জওহরলাল নেহরুও উচ্চকক্ষ রাখতে চেয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ১৩ মে স্বাধীন ভারতে রাজ্যসভার প্রথম অধিবেশন হয়।
কাদের নিয়ে রাজ্যসভা গড়ার কথা ভেবেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা? লোকসভার প্রথম ডেপুটি স্পিকার (পরে অধ্যক্ষ) অনন্তশয়নম্ আয়েঙ্গার বলেছিলেন, ‘‘It is necessary that we should have another house where the genius of the people may have full play.’’
আজকের ‘জিনিয়াস’ তো তাঁরাই, অর্থ এবং বাহুবলে যাঁরা গরীয়ান। রাজনীতি যাঁদের কাছে শুধুই ছকবাজি। তাঁরা আছেন বলেই মধ্যরাতে স্বাধীনতা পাওয়া দেশের মানুষকে মধ্যরাত পার করে গণতন্ত্রের ‘বীভৎস মজা’ দেখতে হয়। সত্তর বছর আগে ১৪ অগস্টের মধ্যরাতে সংসদে দাঁড়িয়ে নেহরু নিয়তির সঙ্গে অভিসারের কথা বলেছিলেন। হায় নিয়তি! সেই অভিসার আজও চলেছে।