উত্তর কোরিয়ার সর্বময় শাসক কিম জং উন। ছবি: এপি।
অশুভ, অকল্যাণকর, অপরিণামদর্শী। উত্তর কোরিয়ার সর্বময় শাসক কিম জং উনের আচরণ এই বিশেষণগুচ্ছকে আপ্রাণ আবাহন করছে। গোটা বিশ্ব নিন্দায় এবং বিরোধিতায় সরব, তাও উত্তর কোরিয়া একের পর গণবিধ্বংসী অস্ত্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ঘটিয়ে সামরিক পেশির বাড়বাড়ন্ত প্রমাণ করতে উদগ্র। বিশ্বের রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক মানচিত্র থেকে উত্তাপের বিকিরণটা এই মুহূর্তে যে রকম, তাতে শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রতি নিজেদের পূর্ণ দায়বদ্ধতার পরিচয় দেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যই সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক কর্তব্য। উত্তর কোরিয়ার কার্যকলাপ এবং ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে দেশের শাসক বর্তমান বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কোনও পরিসরে বাস করেন।
এই প্রথম নয়, আগেও পাঁচ বার পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে উত্তর কোরিয়া। অত্যন্ত উত্তপ্ত এক সময়ের প্রেক্ষাপটে উত্তর কোরিয়া ষষ্ঠ বিস্ফোরণটিও ঘটাল। গোটা বিশ্ব যখন নিন্দায় সরব, তখন বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে উত্তর কোরিয়া জানাল, এ বারের বিস্ফোরণটি এ যাবৎ সবচেয়ে শক্তিশালী। অর্থাৎ, সবচেয়ে বিধ্বংসী। একগুচ্ছ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কটের সমাপতন যখন বারুদের এক সুবিশাল স্তূপে বসিয়ে রেখেছে পৃথিবীকে, তখন শান্তি এবং স্থিতিশীলতার বার্তাই বার বার উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন, সব প্রান্ত থেকে উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ঠিক বিপ্রতীপ অভিমুখে ছুটছে, তারা ধ্বংসলীলার গর্বে বিভোর হচ্ছে, মারণ ক্ষমতার বড়াই করছে।
উত্তর কোরিয়ার জনমত কী বলছে, জানা যায় না। বিশ্ব জনমত কী চাইছে, উত্তর কোরিয়ার জনগণ জানতে পারেন না। স্বৈরাচারের দুর্ভেদ্য পর্দায় সব আদান-প্রদান আটকে যায়। গোটা বিশ্বের কাছে তাই সর্বময় শাসক কিম জং উন-ই উত্তর কোরিয়া, কিম জং উনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই উত্তর কোরিয়ার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কিমের অস্তিত্বই উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্ব। এ হেন শাসক আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে এবং নিজেরই প্রতিশ্রুতি অক্লেশে লঙ্ঘন করে শান্তি-সুস্থিতিকে প্রতি মুহূর্তে যে ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, তা চরম হঠকারিতার উদাহরণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ হেন হঠকারী অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তেমন পদক্ষেপ হলে কিম জং উন যে একা ভুগবেন না, গোটা উত্তর কোরিয়াই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ সত্যও কারও না বোঝার কথা নয়। কিম তাও আস্ফালনে অনড়, ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত। বিশ্ব মানবতা বা বিশ্ব শান্তির প্রতি দায়বদ্ধতা অনেক দূরের কথা, কিম জং উন নিজের দেশের প্রতি দায়বদ্ধ তো? খুব বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হচ্ছে।
দক্ষিণ চিন সাগরের অধিকার নিয়ে চিনের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে আন্তর্জাতিক মতামতের। তার প্রেক্ষিতে ওই জলভাগের বুকে চিন-আমেরিকা দ্বৈরথ ক্রমাগত চলছে। কিন্তু পুরোদস্তুর সামরিক সঙ্ঘাতেই হেস্তনেস্ত করা হবে, এমন একবগ্গা এবং চরমপন্থী বার্তা দু’পক্ষই এড়িয়ে যাচ্ছে।
ডোকলামের সঙ্কট নিয়ে ভারত এবং চিনের মধ্যে বেনজির টানাপড়েনের ছবি গোটা বিশ্ব দেখল। ভারত-ভুটান-চিন সীমান্তে বড়সড় সৈন্য সমাবেশ হল। অনেক প্ররোচনামূলক নিশ্বাসের শব্দও শোনা গেল চারপাশ থেকে। তবু দু’পক্ষই শেষ পর্যন্ত সংযম দেখাল। দুই বৃহৎ শক্তি তথা দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে পুরোদস্তুর সামরিক সঙ্ঘাত যে ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা থেকে বিশ্ব মানবতাকে রক্ষা করার দায়বদ্ধতাই মূলত ভারত আর চিনকে সীমা লঙ্ঘন করতে বাধা দিল।
চোখের সামনে এত বড় বড় দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও কিম জং উন দৃষ্টিহীন, একবগ্গা। ভবিষ্যৎ কী রকম? কিম দেখার চেষ্টা করছেন কি না জানা নেই। কিন্তু গোটা বিশ্ব সিঁদুরে মেঘই দেখছে।