কাহার স্থান কোথায়

আলিপুরদুয়ার হইতে কলিকাতা। জেলাশাসকের পরিবর্তে জনজাতি উন্নয়ন সমবায় নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ‘শাস্তি’ যদি এমন হয়, পুরস্কারের তোয়াক্কা করে কোন আহাম্মক?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসকের পদ থেকে সরিয়ে নিখিল নির্মলকে পাঠানো হল জনজাতি উন্নয়ন সমবায় নিগমের ম্যানেডিং ডিরেক্টর পদে ।

আলিপুরদুয়ার হইতে কলিকাতা। জেলাশাসকের পরিবর্তে জনজাতি উন্নয়ন সমবায় নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ‘শাস্তি’ যদি এমন হয়, পুরস্কারের তোয়াক্কা করে কোন আহাম্মক? আলিপুরদুয়ারের ভূতপূর্ব জেলাশাসক নিখিল নির্মলকে এই ‘শাস্তি’ই দিল রাজ্য সরকার। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁহার স্ত্রীর প্রতি কটূক্তি করিয়াছেন, এই অভিযোগে এক যুবককে থানায় আনিয়া বেধড়ক পিটিয়াছিলেন নিখিল। তাঁহার স্ত্রীও হাত গুটাইয়া থাকেন নাই। ঘটনাটির ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াইয়া পড়ায় নবান্ন সিদ্ধান্ত করে, এই অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। আইএএস অফিসারদের সংগঠনও নিখিল নির্মলের কঠোর শাস্তির দাবি করে। নবান্ন শেষ অবধি এই শাস্তির ব্যবস্থা করিল। প্রহসন বলিলে ঘটনাটির গুরুত্ব লঘু করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও মহিলাকে হেনস্থা করা নিতান্তই অনুচিত কাজ, সন্দেহ নাই। তিনি জেলাশাসকের স্ত্রী-ই হউন বা কোনও সাধারণ নাগরিক, এমন ঘটনার শিকার হইলে পুলিশের দ্বারস্থ হইবার অধিকার তাঁহার আছে। তদন্তে অপরাধ প্রমাণ হইলে অভিযুক্তের শাস্তিও হইবে। কিন্তু, এই গোটা প্রক্রিয়ায় অভিযোগকারী বা তাঁহার স্বামীর ভূমিকা থাকিতে পারে না। তিনি সাধারণ লোক হইলেও নহে, জেলাশাসক হইলেও নহে। থানার ভিতরে কেহ নিজের হাতে আইন তুলিয়া লইতেছেন, এই ঘটনা গোটা রাজ্যের প্রশাসনের জন্য লজ্জার, গভীর দুশ্চিন্তার। যিনিই এমন ঘটনা ঘটান না কেন, তাঁহার কঠোর শাস্তি হওয়া বিধেয়। বিশেষত, তিনি যদি জেলাশাসকের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন।

Advertisement

যে কোনও লোকের পক্ষে অবশ্য থানায় ঢুকিয়া অভিযুক্তকে উত্তমমধ্যম দেওয়া অসম্ভব। তাহার জন্য ক্ষমতাবান হওয়া আবশ্যক। জেলায় জেলাশাসকের অধিক ক্ষমতাবান আর কে? তাঁহার আচরণের আগাপাছতলা সেই ক্ষমতার আস্ফালনে পূর্ণ। তিনি জানিতেন, তাঁহাকে বাধা দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থানার ওসির থাকিলেও সেই সাহস তাঁহার থাকিবে না। ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে ঘটনাটি যে ফাঁস হইয়া যাইতে পারে, নিখিল নির্মলের কল্পনায় সম্ভবত এই কথাটি আসে নাই। হিন্দি ছবির নায়করা যেমন আচরণ করিয়া থাকেন, জেলাশাসক মহাশয়ও বোধ করি ভাবিয়াছিলেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে সেই অধিকার তাঁহারও আছে। জেলার প্রশাসনিক প্রধানেরও যে আইন ভাঙিবার অধিকার থাকে না, এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝাইয়া দেওয়ার জন্যই নিখিল নির্মলের কঠোরতম শাস্তি হওয়া বিধেয় ছিল। সরকার কার্যত পুরস্কারের ব্যবস্থা করিল।

মূল সমস্যাটি গভীরতর। আইএএস অফিসাররা কোনও নাগরিককে পিটিতেছেন, এমন ঘটনা খুব অবিরল না হইলেও নেতা-মন্ত্রীদের হাতে সাধারণ মানুষের দুই-চার ঘা জুটিয়াই থাকে। কখনও টোল প্লাজ়ায়, কখনও শহর কলিকাতার রাস্তায়। এই আচরণগুলির কেন্দ্রে আছে রাজতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব। গণতন্ত্রে যে তাঁহারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বা জনগণের সরকার-নিযুক্ত সেবক, এই কথাটি নেতারাও ভুলিয়া যান, নিখিল নির্মলরাও। তাঁহাদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা। এবং, সেই ক্ষমতাই তাঁহাদের ভাবাইয়া লহে যে তাঁহারা আসলে রাজা, নাগরিকরা প্রজামাত্র। প্রজাকে শাসন করিবার অধিকার রাজার বিলক্ষণ আছে— রাজার কোনও আদালতের প্রয়োজন হয় না। গণতন্ত্রের পরিসরে যে রাজা-প্রজার উচ্চাবচতা থাকিতে পারে না, জেলাশাসক যে সরকারি কর্মচারীমাত্র, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নহেন, এই কথাগুলি বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য নিখিল নির্মলের কড়া শাস্তি হওয়া প্রয়োজন ছিল। এমন শাস্তি, যাহা অন্য ‘রাজপুরুষ’দের প্রাণেও ভীতির সঞ্চার করে। সেই শাস্তি না দিয়া সরকার মানুষকে বুঝাইয়া দিল, ক্ষমতার চক্ষে কাহার স্থান ঠিক কোথায়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement