মাত্র তিনটি মাসের মধ্যে সারা বিশ্ব করোনার দাপটে আক্রান্ত ও বিভ্রান্ত। এর আগে আমাদের পৃথিবী দেখেছে বেশ কয়েকটা মহামারি, প্রায় ১০০ বছর অন্তর। বসন্ত, প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরা আমাদের মানব সভ্যতাকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমান মানবজাতি প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই বিজয়ী হতে পেরেছে অবশেষে। বিজ্ঞানের অপরিসীম অবদান স্থল, জল অন্তরীক্ষ সব ক্ষেত্রেই মানুষকে জয়ী করেছে। কৃষিবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কারিগরি বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের জয় হয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ এই অতিক্ষুদ্রকায় জীবাণুটি সভ্যতাকে কেন এতখানি টালমাটাল করে দিল? গত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি মানবজাতিকে প্রায় নিশ্চিন্ত করে রেখেছে। তা হলে এখন হলটা কী? আসলে এই পৃথিবী তো শুধু মানুষের জন্য নয়, এখানে আরও ছোট-বড় অনেক প্রাণী, কীটপতঙ্গ, জীবাণু ইত্যাদির অগাধ বিচরণ। যে যেখানে পেরেছে তাদের স্থান পাকা করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, জীবাণু, যে-ই হোক না কেন। এই নিরন্তর অশান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সঙ্গেই মানুষকে সর্বদা চলতে হচ্ছে। বেঁচে থাকতে গিয়ে সমানে যুদ্ধ করতে হচ্ছে অদৃশ্য শত্রুদের সঙ্গে।
বিজ্ঞানে পাশ্চাত্য দেশগুলি অনেক এগিয়ে। বলা বাহুল্য নোবেল প্রাইজ়গুলো তাদের দখলে অনেক বেশি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে সেই দেশগুলিই কিন্তু বেশি বিপর্যস্ত। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেও এখনও সফল হননি।
এই বছর জানুয়ারি মাসে চিন থেকে এই ভাইরাস ও তার জিন আবিষ্কার হয়। এই ভাইরাসটির জিনে ডিএনএ-র বদলে আছে আরএনএ। এই আরএনএ-র সিকোয়েন্স প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার, ল্যানসেট, নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ এই ভাইরাসটি সম্বন্ধে অনেক গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশিত। এ পর্যন্ত ৫৫টি দেশের সাড়ে তিন হাজারের বেশি করোনা রোগীর দেহ থেকে আরএনএ ভাইরাস-এর প্রকাশিত সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন এই জীবাণু নিজেকে পাল্টাতে পারে এগারো ধরনে।
এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করি। আফ্রিকান ট্রিপানোজ়োমা একটি পরজীবী প্রোটোজ়োয়া। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই পরজীবীটি গবাদি পশু ও মানুষকে আক্রমণ করে এবং ‘স্লিপিং সিকনেস’ নামে একটি মারণ রোগ তৈরি করে। প্রতি বছর এই রোগের আক্রমণে অনেক গবাদি পশু ও মানুষ মারা যায়। এই পরজীবীটির জেনেটিক মেটিরিয়াল হচ্ছে ডিএনএ। পরজীবীটি মানুষের শরীরে থাকাকালীন ১০০ থেকে ২০০ বার চেহারা পরিবর্তন করে। আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল পরজীবীটির ডিএনএ-তে কী মৌলিক পরিবর্তন হল তা বিশ্লেষণ করা। এই গবেষণা আমরা করেছিলাম ১৯৭৯-৮১ সালে সুইটজ়ারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কী করে পরজীবীরা জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে বার বার তাদের অ্যান্টিজেনিক প্রোটিনকে পরিবর্তন করে এবং আমাদের শরীরে তৈরি অ্যান্টিবডিকে বিভ্রান্ত করে, এই তথ্য উদ্ঘাটিত হওয়ায় ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ে। নাইফর্টিমাক্স, মেলারসুপ্রল, সুরামিন ওষুধগুলি এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। অ্যান্টিজেন প্রোটিনের বারংবার এই চারিত্রিক পরিবর্তনকে ‘অ্যান্টিজেনিক ভ্যারিয়েশন’ বলা হয়। একই ঘটনা ঘটে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও। ম্যালেরিয়ার জীবনচক্রে আমাদের শরীরের মধ্যে অনেক বার তারও শারীরিক পরিবর্তন হয়। সেই কারণে চেষ্টা করা সত্ত্বেও ঠিকমতো সফল ভ্যাকসিন তৈরি হল না এখনও। এখনও ক্লোরোকুইন, আর্টেমিসিনিন ঔষধগুলি প্রয়োগ করা হয়।
এখনকার এই কঠোর লকডাউনের মধ্যেও পরীক্ষাগারে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির লাগাতার প্রচেষ্টা চলছে। একশোরও বেশি ভ্যাকসিন তৈরির খবর সংবাদমাধ্যমে পেয়েছি। এর মধ্যে বেশ কিছু ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। যাঁরা এই ভ্যাকসিন তৈরি করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই ভাইরাসটির অ্যান্টিজেন ভ্যারিয়েশন অথবা জিনোমের পরিবর্তনের দিকটি মাথায় রেখেছেন। গবেষকরা ভাইরাসটির গঠন, অর্থাৎ কত বড় তার আরএনএ, কতগুলি প্রোটিন তৈরি হয় এবং তাদের পরিকাঠামো কেমন ইত্যাদি জানছেন। কী করে তারা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, এই সব তথ্য উদ্ঘাটন করছেন। এই সব তথ্যের ভিত্তিতেই ড্রাগ তৈরির কাজটা এগোবে।
এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা জানা ভাল। সদ্য আবির্ভূত করোনা ছাড়াও কিন্তু এই পৃথিবীতে আরও কিছু জীবাণু জাঁকিয়ে রাজত্ব করে চলেছে। টিউবারকিউলোসিস, ম্যালেরিয়া এবং স্লিপিং সিকনেস-এর জীবাণু— অর্থাৎ ট্রিপানোজ়োমা— এগুলো নিয়ে এত কথাবার্তা না হলেও এরাও কিন্তু কম ভয়াবহ নয়। কলেরা এবং লাইসমানিয়া (কালাজ্বরের জীবাণু) প্রতিরোধে আমরা প্রায় সক্ষম হতে পেরেছি। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী প্রায় ১১০ বছর আগে কালাজ্বরের প্রতিষেধক ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করে লক্ষাধিক আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আর কলেরা গবেষণায় বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে-র অবদান অনস্বীকার্য।
বিশ্ব জুড়ে এখনও পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত প্রায় একষট্টি লক্ষ মানুষ, মৃত পৌনে চার লক্ষ। অন্য দিকে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা এই মুহূর্তে প্রায় কুড়ি কোটি। এই রোগে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় চার লক্ষ (২০১৮-র পরিসংখ্যান)। স্লিপিং সিকনেস রোগটিকে অনেকটা আয়ত্তের মধ্যে আনা সম্ভব হয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি। করোনার মতো টিবি বা যক্ষ্মাও হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। চিন্তার বিষয়, ২০১৮ সালে টিবি সংক্রমণে পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ। এই চিকিৎসার জন্য অনেক ভাল ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতে শিশুদের বিসিজি ভ্যাকসিন দেওয়ার রীতি আছে। অনেক দেশেই এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয় না। অবশ্য ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আফ্রিকায় মালাউয়ি, ঘানা ও কেনিয়ায় ২,৭৫,০০০ শিশুকে প্রথম ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন দিয়েছে।
অর্থাৎ হিসেব বলে অন্যান্য রোগে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই বেশি, তবু করোনা বিশিষ্ট কেননা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে করোনার আচরণ ভয়াবহ। সেই কারণে এই ভাইরাস নিয়ে আমরা এত সন্ত্রস্ত, বিশ্ব জুড়ে এত হইচই। বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনায় নিশ্চয়ই প্রতিষেধক টিকা তৈরি হবে দ্রুত। তবে এও ঠিক যে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারেই সমস্যার সমাধান হবে না, চাই ওষুধ। ভ্যাকসিনের থেকে ওষুধ নিশ্চিত ভাবেই বেশি কার্যকরী। অর্থাৎ ভাইরাস ও সভ্যতার এই যুদ্ধ এখন জারি থাকবে। যুদ্ধের ফল আসা অবধি আমাদের একটাই কাজ: নিজেদের শরীরের প্রতিষেধক ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা।
জগদীশচন্দ্র বসু ন্যাশনাল ফেলো, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি, ইনফেকশাস ডিজ়িজ় ডিভিশন।