ছবি: সংগৃহীত
নদী বাঁচানোর সঠিক পদক্ষেপ শুরু হয় নদী অববাহিকা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে। নদীর সংসার আসলে নদীর অববাহিকা। যেখান থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে নদীতে পড়ে। এই অববাহিকার ক্ষুদ্রতম একক হল জলবিভাজিকা। এই জলবিভাজিকার জীবন ফিরিয়ে দিতে পারলেই নদী বাঁচানো সম্ভব।
আমাদের আলোচ্য ভৈরব নদটি গাঙ্গেয় অববাহিকার নিচের দিকে অবস্থিত। নদী বিজ্ঞানের ভাষায় এই অঞ্চলটিকে আমরা বলি ‘লোয়ার গ্যঞ্জেটিক বেসিন’।এই বেসিনের মধ্যে রয়েছে ২৯৩টি জলবিভাজিকা। যাদের মোট আয়তন ২৮৩.৩৩লক্ষ হেক্টর। এই প্রত্যেকটি জল বিভাজিকার এক একটি নাম রয়েছে। যাকে বলা হয় ‘ওয়াটারশেড কোড’। এই কোড সংখ্যাটি আমরা জানতে পারি ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘অল ইন্ডিয়া সয়েল অ্যান্ড ল্যান্ড ইউজ সার্ভে’-র ‘ওয়াটারসেড অ্যাটলাস অব ইন্ডিয়া’ থেকে। আজ পর্যন্ত ‘ওয়াটারশেড কোড’ এর কোনও পরিমার্জন বা পরিবর্ধণ করা হয়নি। ভৈরব নদটির ‘ওয়াটারশেড কোড’ হল 2A1D4। এই কোডটি জানা থাকলে আমরা ভারতের যে কোনও প্রান্ত থেকে নদটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে পারব। মনে রাখতে হবে ভৈরব নদটির জল বিভাজিকার সঙ্গে জলঙ্গি নদীরও কিছুটা অংশ রয়েছে। এই যুগ্ম জলবিভাজিকাটির মোট আয়তন ৮৪০০০ হাজার হেক্টর।
জল বিভাজিকাকে প্রথমে ক্ষুদ্র জলবিভাজিকাতে ভাগ করা হয়। যার আয়তন হবে ৫০০ হেক্টর। আবার ক্ষুদ্র জলবিভাজিকাতে দ্বিতীয় দফায় অতি ক্ষুদ্র জলবিভাজিকাতে ভাগ করা হয়। যে গুলোর আয়তন ২৫০ হেক্টরের কম। এই অতি ক্ষুদ্র জলবিভাজিকা থেকে নদী বাঁচানোর কাজ শুরু করতে হবে। বৃষ্টির জল অতি ক্ষুদ্র জলবিভাজিকাতে পড়ার পর বাধাহীন ভাবে ক্ষুদ্র জলবিভাজিকাতে আসতে পারছে কিনা, সেটা দেখা প্রথমে প্রয়োজন। তারপর দেখতে হবে জলবিভাজিকা থেকে কতটুকু জল গড়িয়ে নদীতে যাচ্ছে, অর্থাৎ ‘রান অফ’-এর হিসেবটিকে বুঝতে হবে। এই রান অফটি আসলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ। যাকে আমরা নদী বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ইকোলজিকাল ফ্লো’ বলি। এ বার প্রশ্ন হল, বৃষ্টির জলের ধারা নদীতে কোন পথ ধরে আসবে?
নদীর অববাহিকার ভেতরে থাকা অতিক্ষুদ্র জলবিভাজিকা গুলোতে থাকে অনেক ছোট ছোট অদৃশ্য নদী। যেগুলো বোঝা যায় এক মাত্র বৃষ্টির সময়, বৃষ্টির জলের প্রবাহ পথকে দেখে। নদী বিজ্ঞানের ভাষার আমরা এই নদীগুলোকে বলি ‘পেলিও চ্যালেন’। বৃষ্টির জল এই নদীগুলো বয়ে নিয়ে পৌঁছে দেয় ক্ষুদ্র জলবিভাজিকাগুলোতে থাকা সেই সমস্ত নদীতে, যে নদী কেবলমাত্র বৃষ্টির জলেই পুষ্ট। যাকে আমরা বলি ‘নন পেরিনিয়াল সোর্স’। বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী বৃষ্টির জল পৌঁছে দেয় বড় নদীকে।
প্রথমে যে নদী সবার প্রথম বৃষ্টির জল পায় তাদের আমরা প্রথম পর্যায়ের নদী বা ফাস্ট অর্ডার স্ট্রিম বলি। প্রথম পর্যাযের নদী জল পৌঁছে দেয় দ্বিতীয় পর্যায়ে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের নদী জল পৌঁছে দেয় তৃতীয় পর্যায়ের। আমদের আলোচ্য নদ ভৈরবে। কোথায় কতগুলো কোন ধরণের নদী আছে, সেটা জানতে হলে আমাদের ১:৫০,০০০ স্কেলের টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপের প্রয়োজন হয়। সঙ্গে বর্তমান অবস্থা বোঝার জন্য উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করে নদীগুলোর অবস্থার মানচিত্র তৈরি করতে হবে। যাকে নদী বিজ্ঞানের ভাষার বলা হয় ‘ডিজিটাল এলিভেশন মডেল অ্যানালিসিস’। এই মানচিত্রটি তৈরির পরে আমরা বুঝব কোথায় প্রথম পর্যায়ের নদীর সংখ্যা বেশি আর কোথায় কম।
কোনও অঞ্চলের নদী সংখ্যার ওপর নির্ভর করে নিকাশি বা ড্রেনেজ ব্যবস্থা। নদী বাঁচাতে গেলে নিকাশি ব্যবস্থার ঘনত্বকে বুঝতে হয়। যাকে আমরা নদী বিজ্ঞানের ভাষায় বলি ‘ড্রেনেজ ডেনসিটি’। জলবিভাজিকাতে যেখানে প্রথম পর্যায়ের নদীর সংখ্যা বেশি অর্থাৎ ‘ড্রেনেজ ডেনসিটি’ বেশি সেখানে বৃষ্টির জল খুব তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাবে। তাই ওই অংশে জল ধরে রাখার কাজটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জল ধরে রাখতে হবে কি করে? অবশ্যই প্রাকৃতিক উপায়ে। তার জন্য ওই অঞ্চলে তৈরি করতে হবে জল ধরে রাখায় পুকুর। যাকে জল বিজ্ঞানের ভাষার বলা হয় ‘স্টোরেজ ট্যাঙ্ক’।
আবার জলবিভাজিকার যে অংশে প্রথম পর্যায়ের নদীর সংখ্যা খুব কম, সেই অংশটি নদী বাঁচানোর ক্ষেত্রে একটু বেশি গুরুত্ব পাবে। কারণ এই অংশের বৃষ্টির জল নিকাশি হতে বেশি সময় নেবে। যেহেতু প্রথম পর্যায়ের নদীর সংখ্যা কম, তাই ‘ড্রেনেজ ডেনসিটি’ও কম। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলটিতে তৈরি করতে হবে জল ভরার পুকুর, যাকে আমরা বলি ‘পার্কোলেশন ট্যাঙ্ক’। এই প্রকৃতির পুকুর তৈরি করে আমরা মাটির তলায় জল ভরতে পারব। দীর্ঘ বালির স্তর না পাওয়া পর্যন্ত পুকুরকে গভীর করতে হবে। এই ধরনের পুকুর অনেক গভীর হয়। কিন্তু পুকুরগুলোতে বেশি সময় জল থাকবে না। কারণ পুকুর আসলে পৃথিবীর বুকে ফানেলের মতো কাজ করে।আর বালির স্তর ব্লটিং পেপারের মতো। মেঘ থেকে ঝরে পরা জল বালির স্তর ভেদ করে পরিষ্কার হয়ে পৃথিবীর পেটের ভেতরে থাকা জলকে সমৃদ্ধ করে।
মাটির তলায় থাকা জল নদী বাঁচানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শুখা সময়ে ভৈরবে যখন জল থাকবে না, তখন সে যেন মাটির তলার জল চুঁইয়ে বা ‘বেস ফ্লো’-র মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারে। তার জন্য নদী সংলগ্ন মাটির তলার জলাধারটিকে সব সময় ভরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এ বার প্রশ্নটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। তা হল কোথায় কতগুলো পুকুর কাটানো হবে? প্রথমেই বুঝে নিতে হবে, নদীতে শুখা মরসুমে জল রাখতে গেলে কতটুকু জল ধরতে হবে। যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, তার ৭০ থেকে ৭৪ শতাংশ বাষ্পমোচনে প্রকৃতিতে ফিরে যায়।এই অপচয়টিকে আমরা কোন ভাবেই আটকাতে পারব না। বাকি জলের মধ্যে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ জল প্রাকৃতিক প্রবাহ হিসাবে নদীতে প্রবাহিত করে দেওয়া ভাল। এতে নদীর শরীর সুস্থ থাকে। বাকি যেটুকু জল অবশিষ্ট রইল তাকেই ধরতে হবে। এই জলের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করেই পুকুরের সংখ্যা ঠিক হবে। নদী অববাহিকা বিশেষে এই সংখ্যা পরিবর্তনশীল।একটা মৃতপ্রায় নদী বাঁচাতে নূন্যতম তিন থেকে সাড়ে তিন বছর সময় লাগে। আর তার সঙ্গে লাগে নদী নিয়ে দীর্ঘ অনুশীলন। একই সঙ্গে জল বিভাজিকার প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশে ভূমিক্ষয় কমানোর কাজ করে যেতে হবে। তা হলেই ভৈরব বাঁচবে। না হলে আর পাঁচটা সরকারি প্রকল্পের মতো এই পরিকল্পনা দ্রুতই মুখ থুবড়ে পড়বে।