প্রতীকী চিত্র।
জল নিয়ে কান্নাকাটি করার সময় আমরা ক’জন জলের অপচয় রোধে সচেষ্ট হয়েছি বা শপথ করেছি যে ভবিষ্যতে অপচয় করব না? ক’জনই বা একটু গুগল করে দেখেছি যে, আমরা নিত্য দিন যে সব জিনিস খাই বা ব্যবহার করি, তার মধ্যে কোন কোনগুলো তৈরি করতে বেশি জল লাগে? আমরা ক’জন ঠিক করেছি যে, তা হলে জল বেশি লাগে যে সব জিনিস তৈরিতে, সেগুলো আমরা আর ব্যবহার করব না?
আমরা প্রায়শই চিন্তা করি অরণ্যবাসীদের বাস্তুচ্যুত হওয়া নিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অরণ্য কেটে, অরণ্যবাসীদের উৎখাত করে যে কাজটি করা হয়, তা হল খনিজ আহরণ। এক বারও কি আমরা ভেবেছি তা হলে যে ধরনের খনিজ পদার্থ তোলার জন্য তাঁদের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়, সেগুলো আমরা একটু কম ব্যবহার করি? আমাজনের সেলভা অরণ্যে আগুন লাগা বা লাগানো নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। পৃথিবীর ফুসফুস নষ্ট হওয়ার আগে যখন যকৃৎ ও হৃদ্যন্ত্র বিকল হচ্ছিল, তখন আমাদের ঘুম ভাঙেনি। আমরা যখন কাঠের জিনিস বানাই, এক বারও কি ভেবে দেখি যে কোথাও তো একটা গাছ কাটা হল! কাঠের ব্যবহার আমরা বন্ধ করেছি কি?
আমাদের নিজের শহরে যখন বর্ষায় জল জমে, তখন আমরা চিন্তিত হই। কিন্তু সারা বছর ধরে যখন আমাদের চোখের সামনে পুকুর ও জলা বোজানো হয়, আমরা কি এগিয়ে গিয়ে তার কোনও প্রতিবাদ করি? বরং উল্টে অপেক্ষা করি, কবে সেখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হবে, যেখানে আমরা আর একটা ফ্ল্যাট নিজের বা কোনও নিকট আত্মীয়ের জন্য কিনব। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু এসি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসি গাড়িতে চড়ে এসি অফিসে কাজ করে আবার এসি বাড়িতে ফেরার সময় আমরা কখনও কি ভেবে দেখি, কত পরিমাণ ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এবং কার্বন মনোক্সাইড বাতাসে মেশালাম? আমাদের মোবাইল ব্যবহার এত বেড়েছে যে আজকাল রাতে চার্জ করে সারা দিন চলে না, পাওয়ার ব্যাঙ্ক লাগে। আমরা প্রতি দিন যতগুলো গ্যাজেট ব্যবহার করি এবং তার জন্য যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করি তার সবটা যোগ করলে দেখব, আমাদের শক্তি উৎপাদনের জন্য পরিবেশ নষ্ট করায় নিজেদের দায় কতখানি। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।
পাহাড়ের অত্যন্ত দুর্গম এলাকা পর্যন্ত আমাদের বেড়াতে যাওয়ার জন্য রাস্তা চাই, প্রচণ্ড জল সঙ্কটের জায়গায় গিয়েও আমাদের প্রচুর জল চাই, আমাদের সর্ব ক্ষণ প্রচুর শক্তির জোগান চাই। আমাদের আরামে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটলে চলবে না। হেঁটে যেতে পারব না বলে আমাদের হেলিকপ্টারে করে কেদারনাথ দর্শনে যাওয়া চাই। কিন্তু আমরাই আবার পাহাড়, জল, পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে চেঁচাব। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষত খনিজ তেল বাঁচানোর জন্য গাড়ি বা প্লেনের ব্যবহার কমাব না, কিন্তু বলব, তেল তুলতে গিয়ে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমরা এখন গ্রীষ্মে শীতের আনাজ আর শীতে গরমের আনাজ খাই। কেননা আমাদের এখন ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, আর তা ছাড়া অন্য ঋতুর দামি সবজি খাওয়ার মধ্যে কেমন একটা বড়লোকি আত্মতৃপ্তি আছে। কখনও কি ভেবেছি যে বিপরীত ঋতুর ফসল ফলাতে গেলে কয়েক গুণ বেশি কীটনাশক লাগে, যাতে মাটি নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি? ভাগ্যিস দেশে দেশে এখনও অনেক গরিব মানুষ আছেন, যাঁরা প্রায় তেমন কিছুই সম্পদ ও শক্তি ব্যবহার করেন না— ফলে, আমাদের মাথাপিছু গড় শক্তি ও সম্পদের ব্যবহার কম থাকে।
সভ্যতার উন্নতিতে আমরা এগিয়ে চললাম প্রকৃতির জল, সম্পদ, বায়ু, অরণ্য ধ্বংস করে। পৃথিবীকে বাঁচানোর রাস্তা আমরা ভুলে গেলাম সভ্যতার চাপে। সে মন্ত্র আজও যাঁদের কাছে আছে, তাঁরা হলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষজন। সে দিন একটি লেখায় পড়লাম, কানাডার সরকার তাঁদের সাহায্য নিয়েই তৈরি করছে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর রোডম্যাপ। আর একটা আশার কথা যে, গ্রেটা থুনবার্গের মতো কিছু নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে আমাদের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে চাইলে কী করা উচিত। তবে আমরা ভারতবাসী এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসব বলে পরিবেশের তোয়াক্কা না করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে এগোচ্ছি। আমরা ধরেই নিয়েছি যে বাজার হল আমাদের ভগবান। সরকারি কল্যাণের আর কোনও প্রয়োজন নেই।
আসুন, আয়নার সামনে একটু দাঁড়াই। বাড়ির ঝুল ঝাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মনের ঝুলগুলোও একটু ঝেড়ে নিই। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজেদের আরাম ছেড়ে বলি ‘আমাদের আরাম নাও, সভ্যতা নাও, আমাদের পুরনো অসভ্য পৃথিবী ফিরিয়ে দাও, যেখানে আমরা গরিব ও আদিবাসীদের কাছ থেকে শিখে নিতে পারি প্রকৃতি নষ্ট না করে কী করে বাঁচতে হয়!’